‘ধর্ষণের পর রুম্পা হত্যা’,সঙ্গে জড়িত হিসেবে সন্দেহের তীর রিফাত নামে তার এক সহপাঠীর দিকে
সহপাঠীকে সন্দেহ

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা (২১) হত্যার এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের ধারণা, রুম্পাকে ধর্ষণের পর সিদ্ধেশ্বরীর কোনো একটি ভবন থেকে নিচে ফেলে হত্যা করা হয়।
আর এর সঙ্গে জড়িত হিসেবে সন্দেহের তীর রিফাত নামে তার এক সহপাঠীর দিকে। তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এ নিয়ে এখনো পরিষ্কার করে কোনো কিছু বলতে রাজি নন। এদিকে রুম্পা হত্যার ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাস এবং রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
এছাড়া একই দাবিতে আজ শনিবারও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমণ্ডি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে।
রুম্পা হত্যা মামলার তদন্তে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তারা আলোচিত এই হত্যার সুনির্দিষ্ট কোনো ক্লু খুঁজে বের করতে পারেননি। তবে রুম্পার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে হত্যাকাণ্ডের রহস¨ উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। কারা তাকে বাসার নিচ থেকে কেন ডেকে নিয়ে গেছে সেটা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম গতকাল বিকেলে বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যার পর রুম্পা বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। তিনি নিজের মোবাইল ফোনটিও সঙ্গে নেননি। তার মৃত্যুর বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। সেটার তদন্ত চলছে।’
রুম্পা হত্যা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শান্তিবাগে রুম্পার বাসার গলি ও যেখানে রুম্পার লাশ পাওয়া গেছে সেখানকার কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো আমরা বিশেস্নষণ করে দেখছি। আশা করছি শিগগিরই রুম্পার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন এবং ঘাতকদের গ্রেপ্তার করা যাবে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রুম্পার মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে জানা যাবে, কে তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়েছে। কারণ বাসা থেকে রুম্পাকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রেমঘটিত বিষয়কেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’
জানা গেছে, ঘটনার দিন রুম্পা দুটি টিউশনি শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। পরে কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসা থেকে নিচে নেমে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও জুতো বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে এক জোড়া পুরনো স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে চলে যান। রাতে আর বাসায় ফেরেননি তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রুম্পার চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাতিজির সঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি ছেলের সম্পর্ক ছিল। তাদের ভেতরে ঝামেলা চলছিল বলে আমরা শুনেছি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই ছেলের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। কর্তৃপক্ষ ওই ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
নজরুল জানান, ঘটনার দিন বকালে রুম্পা পাশের একটি বাড়িতে টিউশনি করতে গিয়েছিল। সেখান থেকে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আবার নিচে চলে যায়। এরপর রুম্পা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক চাচাতো ভাইকে ফোন করে বাসার নিচে স্যান্ডেল আনতে বলে। শিশুটি স্যান্ডেল নিয়ে এলে পায়ের হিল খুলে স্যান্ডেল পরেন রুম্পা। ওই চাচাতো ভাইয়ের কাছে নিজের কানের দুল, মোবাইল ফোন, ঘড়ি, হিল জুতো ও টাকাসহ নিজের ব্যাগটি দিয়ে রুম্পা সেগুলো ওপরে নিয়ে যেতে বলে। একই সঙ্গে মাকে বলতে বলে, তার আসতে দেরি হবে।
চাচা নজরুল বলেন, ‘আমার প্রশ্ন কেন সে এগুলো রেখে যাবে? আত্মহত্যার পরিকল্পনা? তাই হলে তো নিজের বাড়ির ছাদই আছে। সেটা বাদ দিয়ে আত্মহত্যার জন্য বাইরে যাবে কেন? নাকি কোনো ঝামেলা ছিল? তাই এগুলো রেখে গিয়েছিল। এসব ভালো করে তদন্ত করতে হবে।’
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের একজন শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী রিফাতের সঙ্গে রুম্পার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। মৃত্যুর আগে কয়েক দিন ধরে তাদের মধ্যে টানাপড়েন চলছিল।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ নাহিদ নেওয়াজ বলেন, ‘আমি রুম্পাদের ৬৯ ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস নিয়েছিলাম। সে শান্ত ও লক্ষ্মী মেয়ে ছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্ট্রে বার্ড’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’
রমনা থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সিদ্ধেশ্বরীর যে বাড়ির সামনে (৬৪ / ৪ নম্বর) রুম্পার লাশ পাওয়া যায়, তার পাশে আরও দুটি ভবন রয়েছে। আমরা ধারণা করছি, এর যেকোনো একটি ভবন থেকে রুম্পাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি।’
রুম্পা মালিবাগের শান্তিবাগে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়াবাসায় থাকতেন। তার বাবা রোকনউদ্দিন হবিগঞ্জে পুলিশের পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন। ময়নাতদন্ত শেষে গত বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে রুম্পার মরদেহ গ্রহণ করেন তার ভাই আশরাফুল ইসলাম।
আন্দোলনে উত্তাল স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়: রুম্পা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার সকালে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিলসহ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে যান শিক্ষার্থীরা। রুম্পা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। প্রশাসন যথেষ্ট কর্মতৎপর আছে। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এই অবস্থায় তদন্ত ছাড়া তারাও কিছু বলতে পারছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অদিত রহমান বলেন, ‘হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।’
গতকালের মানববন্ধনে উপস্থিত প্রায় প্রত্যেকের হাতে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী ফেস্টুন ও ব্যানার দেখা গেছে। ব্যানারে লেখা ছিল ‘বাংলার মাটিতে ধর্ষকের ঠাঁই নাই’। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মুক্তমঞ্চে ধর্ষকের ফাঁসির দাবি জানান। রুম্পার হত্যাকারীদের চিহ্নিত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আজ শনিবারও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমণ্ডি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। এতে অংশ নেওয়ার জন্য স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর প্রতি আহ্বান জানানো হয় গতকালের কর্মসূচি থেকে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার রুম্পাকে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বিজয়নগরে দাফন করা হয়েছে।
গত বুধবার রাত পৌনে ১১টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীর ৬৪ / ৪ নম্বর বাসার সামনে রুম্পার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন ওই ভবনের এক নিরাপত্তা কর্মী। সেদিন অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করে মরদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। পরদিন সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে খবর দেখে পরিবারের সদস্যরা রমনা থানায় গিয়ে ছবি দেখে রুম্পার লাশ শনাক্ত করেন।