ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


আমাদের এগিয়ে থাকাই স্বাধীনতার বড় প্রাপ্তি : কাজী খলীকুজ্জমান

সব সূচকে পিছিয়ে পাকিস্তান


১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:১১

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৫

আজ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ সাল। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ যখন বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে তখন অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে।

তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো ভিত্তি ছিল না সে সময়। অথচ তখন যে দেশটির কাছ থেকে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিল। মাঝে কেটে গেছে ৪৮টি বছর। এই সময়ের মধ্যে সেই তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল একটি দেশ। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান এগিয়েছিল। আজ ৪৮ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন।

যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ, যাতে আমরা শুধু পাকিস্তান নয়, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছি। নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চিহ্নিত করেছে ‘বিস্ময়কর ধাঁধা’ হিসেবে। বাংলাদেশের অর্জনগুলো নিয়ে আমরা আজ গর্ব করতে পারি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে খোদ পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও প্রশংসা করেছেন। কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হয় তার উদাহরণ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছেন।

অতি সম্প্রতি ইসলামাবাদে এক সম্মেলনে ইমরান খান বলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। ‘পাকিস্তানের বিপজ্জনক জনসংখ্যা বৃদ্ধি’ শীর্ষক ওই সম্মেলনে ইমরান খান বলেন, ‘শৈশবে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল বেশি জনসংখ্যার পূর্ব পাকিস্তান আমাদের জন্য বোঝা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে কেবল তাদের দূরদর্শী চিন্তা ও পরিকল্পনার কারণে।

বাংলাদেশ কিভাবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গছে, তার একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ছিল ১৮০ ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার, পাকিস্তানের ১ হাজার ৬৪১ ডলার। বিদায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য। পাকিস্তান রফতানি করেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য।

অথচ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তানের রফতানি ছিল ৭৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৪৮ বছর আগে আমাদের রফতানি ছিল পাকিস্তানের অর্ধেকেরও কম। আর এখন আমাদের রফতানি পাকিস্তানের দেড়গুণেরও বেশি। তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, যা বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের পরই।

আর পাকিস্তানের অবস্থান ১৭ নম্বরে। বিদায়ী অর্থবছরে চীন পোশাক রফতানি করেছে ১৪৫.৬ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ পোশাক রফতানি করে ৩৪.৮ বিলিয়ন ডলারের। সেখানে পাকিস্তান পোশাক রফতানি করে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলারের, আর প্রতিবেশী দেশ ভারত রফতানি করে ১৭.৩ বিলিয়ন ডলারের।

বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি, ১৯৭২ সালে যা বেশ কম ছিল। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের সমান বাংলাদেশের ৮৪ টাকা আর পাকিস্তানের ১৪১ রুপি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩২ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার।

১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, পাকিস্তানের ৫৪ বছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে দেখা যায়, ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৫তম আর পাকিস্তান ১৫২তম। বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। আর পাকিস্তানের শিশুরা ৩৯ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদনমতে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ অনেকটাই পেছনে ফেলেছে ভারত ও পাকিস্তানকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল নেপালই বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্ব›দ্বী অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬২, পাকিস্তানের ৫২ ও শ্রীলঙ্কার ৪০।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এ বছর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচে থাকবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

একই সময় পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) নভেম্বর মাসের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ যেখানে ৪৩৪ ডলার সেখানে পাকিস্তানের ৯৭৪ ডলার।

জাতিসংঘের শ্রম বিষয় আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলওর দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী কাজের সঙ্গে যুক্ত, পাকিস্তানে তা ২৫ দশমিক ১ শতাংশ। ক্ষুধা দূর করার ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। চলতি বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ৯৪তম আর ভারতের অবস্থান ১০২তম।

সার্বজনীন উন্নত সূচকেও পাকিস্তান-ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী উদীয়মান অর্থনীতির তালিকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ৩৪ নম্বরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সেখানে পাকিস্তান ৫২তম এবং ভারত ৬২তম।

নবজাতক-মৃত্যু ও ৫ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এক হাজার জীবিত শিশু জন্ম গ্রহণ করলে বাংলাদেশে ২৮ দশমিক ২ জন নবজাতক মারা যায়। ভারত ও পাকিস্তানে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৩৪ দশমিক ৬ এবং ৬৪ দশমিক ২। একইভাবে ৫ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভালো করেছে।

বাংলাদেশে ১ হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে ৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৩৪ দশমিক ২ জন মারা যায়। পাকিস্তানে তা দ্বিগুণের বেশি, ৭৮ দশমিক আট জন। আর ভারতে ৪৩ জন। সন্তান প্রসবজনিত মাতৃমৃত্যু হারেও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ অন্তঃসত্বা মায়ের মধ্যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে গড়ে ১৭৬ জন মারা যান।

পাকিস্তানে এই সংখ্যা ১৭৮। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ১.১ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যা ২ শতাংশ। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার এখন ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ। ভারতে তা ৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ।

ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বেশি। বাংলাদেশে সংসদে যত আসন আছে, এর মধ্যে ২০ দশমিক ৩ শতাংশই নারী প্রতিনিধি। পাকিস্তানে তা ২০ শতাংশ এবং ভারতে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।