ঢাকা শুক্রবার, ২রা মে ২০২৫, ২০শে বৈশাখ ১৪৩২


ময়লা-আবর্জনার ধোঁয়া: বাড়াচ্ছে রাজধানীর বায়ুদূষণ


১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:২০

আপডেট:
২ মে ২০২৫ ১৭:৫৭

সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

গত বুধবার বেলা ৩টা বেজে ৪৮ মিনিট। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক থেকে মূল ভবনের দিকে যাওয়ার সময় ডান দিকে গাছ-গাছালি ঘেরা স্থান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। কাছে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত দুটি স্থান থেকে ধোঁয়া উঠছে। কাছাকাছি আরও কয়েকটি স্থানে দেখা গেলো ছাইয়ের স্তূপ। ধোঁয়া ওঠা স্থানগুলোর একটি গর্ত করা। স্থানগুলোতে গাছের শুকনো পাতাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় থেমে থেমে আগুন জ্বলে উঠছে, আর অনবরত ধোঁয়া উঠছে। পশ্চিমের বাতাসে ধোঁয়া যাচ্ছে পূর্বদিকে ফুটপাত হয়ে মূল সড়কে।

রাজধানী ঢাকার ফুসফুসখ্যাত রমনা উদ্যানঘেঁষা সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে আছে বেশ গাছ-গাছালি। নতুন ভবন নির্মাণকাজের কারণে বেশ কিছু গাছ কাটা পড়লেও এখানে দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ এখনো বিদ্যমান। কিন্তু বিড়ম্বনাও আছে।

প্রাকৃতিক নিয়মে এখানেও শীতকালে গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়ে তা বসন্ত পেরিয়ে চলে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। আর কুড়িয়ে স্তূপ করে রাখা এসব পাতা সরানোর ঝামেলা এড়াতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। দিনভর এসব পাতাসহ ময়লা-আবর্জনাতে ধোঁয়া তৈরি হতে থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ময়লার ভাগাড়ের চিত্রই এমন, সেগুলোতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ফলে ধোঁয়া উড়তে থাকে। তবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনের এই চিত্রকে গড়পড়তা সমস্যা হিসেবে দেখতে রাজি নন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নির্দিষ্ট জায়গায় না ফেলে এভাবে ময়লা আবর্জনায় আগুন দিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনের যখন এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তখন সাধারণ মানুষও বিষয়টিকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে ভাববে না।

গত বুধবারের এই চিত্র যে নিত্যনৈমিত্তিক, তা বোঝা যায় সুপ্রিম কোর্টের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথাতেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দৈনিক জানান, ঝরে পড়া পাতা কুড়িয়ে জড়ো করা হয়। কিন্তু তা আবার কাছের ময়লার ভাগাড়ে বয়ে নেওয়া কষ্টকর। তাই আগুন ধরিয়ে দিয়ে ছাই করে ফেলা হয়। ধোঁয়া ওঠা স্থানগুলোর একটিতে গর্ত করা প্রসঙ্গে তারা জানান, সারা বছর ওই স্থানেই ময়লা জড়ো করে আগুন দেওয়া হয়। কিন্তু শীতকাল থেকে বসন্ত হয়ে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত পাতা বেশি ঝরার কারণে বিভিন্ন জায়গায় আগুন দিতে হয়। অন্যসময় শুধু ওই গর্তেই আগুন দেওয়া হয়।

তারা জানান, শীতকালে আবর্জনা শুকনো থাকার কারণে তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়, ফলে তুলনামূলক ধোঁয়া একটু কম হয়। কিন্তু বর্তমানে মাঝেমাঝে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ময়লা আবর্জনা ভেজাভেজা হয়ে থাকে। ফলে ধোঁয়াও বেশি হয়।

প্রসঙ্গত গত শনিবার মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিল পরিদর্শনে গিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বর্জ্য না পোড়ানোর নির্দেশ দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো জায়গাতেই কোনোভাবেই ময়লা পোড়ানো যাবে না।

পরিবেশ উপদেষ্টার এমন অবস্থানের মধ্যেও সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে অব্যাহতভাবে ধোঁয়া উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিত জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সভাপতি ও রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডাক্তার লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়া যেখান থেকেই উঠুক, তাতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্থানে এমন হওয়া উচিত না। এই সচেতনতার গুরুত্ব না বুঝে যারা এটি করছেন, তাদেরকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে হবে। না হয়, সাধারণ মানুষকে সচেতন করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, আবর্জনা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট এসব ধোঁয়ার কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এসব গ্যাস বাতাসে মিশে মানুষের শ্বাসতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। এ ছাড়া কিডনি, লিভার ও ব্রেনেরও ক্ষতি হয়।

উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণে গত বছর দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর রাজধানী ঢাকা ছিল নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে। গত নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ক্লিয়ারিং দ্য এয়ার: অ্যাড্রেসিং বাংলাদেশস এয়ার পলিউশন ক্রাইসিস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানোর অবদান ১১ শতাংশ।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২-এর ধারা ১২ অনুযায়ী বর্জ্যে বা তার কোনো অংশে যত্রতত্র খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো নিষেধ। বিধিমালায় বলা আছে- রাস্তা, সড়ক, মহাসড়কের পাশে কোনো অবস্থায় বর্জ্য পোড়ানো যাবে না। এটি ভঙ্গ করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

গত বুধবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞাকে হোয়াটসঅ্যাপে এ-সংক্রান্ত ছবি এবং ভিডিও পাঠানো হয়। যার ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘‘কোনো জায়গাতেই ময়লা ‘পোড়ানো যাবে না’ বলে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। অথচ সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে প্রতিদিনের চিত্র- ময়লা পোড়ানো এবং ধোঁয়া ওড়ানো। আদালতে আসা বিচারপ্রার্থী এবং পাশেই প্রধান সড়ক ধরে চলা সাধারণ মানুষ তা দেখছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনের এই চিত্র দেখে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি তাদের কাছে আর অপরাধকর্ম মনে না হয়ে বরং স্বাভাবিক মনে হতে পারে। এই বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য কী?”

জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা এর জবাব না দিলেও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (সার্বিক ও আদি অধিক্ষেত্র) এইচ এম তোয়াহা ফোন কল দিয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেল ময়লা পোড়ানো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ অনুসারে আমি সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এটি যে দণ্ডনীয় অপরাধ, তা তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছি। আশা করছি সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে আর ময়লা পোড়ানোর ঘটনা ঘটবে না।

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও নির্দিষ্ট ওই গর্তে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে এবং একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে কুড়িয়ে আনা পাতাসহ ময়লা আবর্জনা ওই গর্তে ফেলতে দেখা যায়।