তুষারের সঙ্গে কথা বলা সেই এনসিপি নেত্রীর পরিচয় মিলল

জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষারের সঙ্গে এক নারীর কথোপকথনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। একপর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠা ‘নৈতিক স্খলনের’ অভিযোগের বিষয়ে তুষারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় এনসিপি। এ বিষয়ে নিষ্পত্তি না হওয়ার পর্যন্ত তুষারকে দলের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে ফাঁস হওয়া কথোপকথনে তুষারের সঙ্গে লিপ্ত নারীটি কে ছিলেন, তা নিয়ে ফেইসবুকে চলতে থাকে জল্পনা-কল্পনা। সন্দেহের তীর যায় এনসিপিরই আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনূভা জাবীনের দিকে। শুরু হয় তাকে নিয়ে নানা ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য। এনসিপির এই নেত্রী ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে জানাতে বাধ্য হন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়া কথোপকথনের নারীটি তিনি নন; অন্য কেউ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার নীলা ইস্রাফিল নামে এক নারী এবিষয়ে মুখ খোলেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রয়াত এ এফ হাসান আরিফের সাবেক পুত্রবধূ। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে নীলা ইস্রাফিল কেবল সরোয়ার তুষার নয়, তার প্রয়াত শ্বশুর নিয়েও বেশ কিছু অভিযোগ আনেন।
আজকের পত্রিকার পাঠকদের সামনে নীলা ইস্রাফিলের ব্ক্তব্যের পুরোটাই তুলে ধরা হলো।
‘আমার নাম নীলা ইস্রাফিল।
আমি এনসিপির সদস্যা হই বা না হই-
আমি একজন যোদ্ধা।
আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে লেক্সাসে চড়তাম। ২৬ জন কাজের লোক ছিল। আরাম আয়েশের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু খারাপ প্রস্তাব পাওয়ার পর আমার শ্বশুর প্রয়াত উপদেষ্টা সুফি চেহারার আড়ালে বিভৎস হাসান আরিফকেও আমি ছাড় দেই নাই।
আমার এথিক্সের সাথে যায় না বলে আমি পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের সব চেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটির অন্যায়কে প্রতিবাদ করেছি।
আমি জানি আমি যা বলেছি তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
এটা অবিশ্বাস্য। আমি জানতাম, এত সুদর্শন, এত অভিজাত, এত সম্মানিত একটা মানুষকে অসম্মান করার অপরাধে সমাজে আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
কিন্তু সেটা জেনেও আমি আমার প্রতি করা অবিচারের প্রতিকার চেয়ে গিয়েছি—অসংখ্য প্রলোভন দেওয়া সত্ত্বেও আপোষ করিনি। এর পরিণতিতে আমার নামে ১৯টি মামলা দেওয়া হয়, কোনো উকিল ওয়ান ইলেভেনের উপদেষ্টা, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফের বিপক্ষে দাঁড়ায় নাই।
আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয়েছে কারাগারে, আমি এখন পর্যন্ত আমার দুই মেয়েকে নিয়ে একসাথে ঘুমাতে পারিনি।
২০২০ সালে আমার পেটের বাচ্চাকে লাথি দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
আমি তাও এখনো প্রয়াত উপদেষ্টা হাসান আরিফ, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ ও ডিবির সাথে লড়াই করে যাচ্ছি।
আমার কাছ থেকে আপনারা কীভাবে আশা করেন যে, তুষারের আমার সাথে এই আচরণের আমি প্রতিবাদ করব না?
গণ-অভ্যুত্থানে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনে রাস্তায় নামার কারণে, হাসান আরিফ আমার বাচ্চা দুইটাকে রেখে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। তিনি আমাকে বলেন যে, আমার কারণে আওয়ামী লীগ বাসায় পৌঁছে যাবে।
এই সময়ে গণ-অভ্যুত্থানের সাথে গড়ে ওঠা, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারা আমার প্রতি করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়ায়।
আমি সপ্রতিভ, কর্মোদ্যম ও সৃজনশীল মানুষ। ফলে আগস্টের পর থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন নেতা ও কর্মীর সাথে আমার আলাপ হত। তুষারের সাথে তখনই পরিচয় এবং এনসিপির জন্মের পূর্বেই তার সাথে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক আলাপ হতো।
বিগত ডিসেম্বরে আমার প্রাক্তন স্বামী মুয়াজ আমাকে ঢাকা ক্লাবে সবার সামনে স্টেক নাইফ দিয়ে হত্যা চেষ্টার পর শহিদুল ভাই, সারা আপা, ফজিয়া করিম আন্টি সহ বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা আমাকে নিরাপত্তার নিয়ে বিচলিত হয়ে যায়। সেজন্য মানবাধিকার কর্মী Rezaur Rahman Lenin আমাকে নেপালে পাঠিয়ে দেয়। নেপালে যাওয়ার পর থেকে তুষার প্রায়ই ফোন করতো ও তার আলাপের ধরন পাল্টাতে থাকে। সে আমাকে বিভিন্নভাবে অ্যাপ্রোচ করতে থাকে—
“তোমার ছবি দাও, ”
“তোমার ঠোঁট সুন্দর, ”
“তোমার স্লোগান, তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাকে আকৃষ্ট করে। ”
আমি তুষারকে এই ধরনের আলাপে সব সময়েই বিব্রত বোধ করেছি এবং তাকে আমাদের সম্পর্ক সাংগঠনিক ও ফর্মাল রাখতে অনুরোধ রেখেছি।
যেহেতু বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি, এনসিপি আমার জীবনের প্রধান অবলম্বন, আমি তুষারকে তার আগ্রাসী আচরণ সংযত রেখে, ফর্মালভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি। বাংলাদেশের অসংখ্য নারীকে ক্ষমতাবান পুরুষের সাথে এই ধরনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়।
ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। রোজার সময় একদিন তুষার আমাকে অত্যন্ত আপত্তিকর একটি কথা বলে।
ইতিপূর্বে সকল আলাপের সীমা ছাড়ানো এই আলাপে আমি বিব্রত বোধ করি এবং ওকে জানাই যে আমি আর কথা বলতে চাই না। কিন্তু তুষার আমাকে আলাপের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকে।
এক পর্যায়ে তুষার আমাকে জানায় ডিটেকটিভ পুলিশ বা ডিবি ওর সাথে কথা বলেছে, সেই বিষয়ে সে আমার সাথে আলাপ করতে চায়।
যেহেতু আমি তখন উপদেষ্টা হাসান আরিফের মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এবং তুষার আমাকে ডিবির কথা বলেছে, তাই আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি নিশ্চয়ই আইনি, ডিবি ও পুলিশসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হতে পারে এবং আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কোনো বিষয় থাকতে পারে—এই বিবেচনায় আমি আলাপটি রেকর্ড করি।
প্রায় দেড় ঘণ্টার আলাপে ৪৭ মিনিট আমি রেকর্ড রাখি।
তুষার আমাকে জানায়, ডিবি তাকে নীলা ইস্রাফিল সম্পর্কে জানতে চেয়েছে এবং সে ডিবিকে জানিয়েছে যে নীলা তার গার্লফ্রেন্ড—যা নিয়ে আমি তুষারকে প্রশ্ন করি।
তাছাড়া আমরা তুষারের খারাপ প্রস্তাব নিয়েও আলাপ করি।
আমি তাকে প্রশ্ন করি, আমার কোনো অ্যাটিটিউড, ব্যবহার বা আচরণে মনে হয়েছে আমাকে এই ধরনের প্রস্তাব করা যেতে পারে?
তুষার আমাকে বিষয়টি ভুলে যেতে বলে।
কিন্তু তুষারের খারাপ প্রস্তাব ও তুষারের সাথে ডিবির যোগাযোগের বিষয়টি আমি মানবাধিকার কর্মী রেজাউল করিম লেনিন ও তুষারের এক্স-গার্লফ্রেন্ড বিথি সপ্তর্ষিকে জানাই। আমার নিরাপত্তা ও ডিবির প্রসঙ্গ থাকায় নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি তুষারের সাথে আলাপের অডিওটি সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরকেও শেয়ার করি। আমার নিরাপত্তা হুমকি ও আমার পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজন পরলে প্রকাশের অনুমতি দিয়ে রাখি।
আমি প্রচণ্ড আহত হলেও, কাছের বন্ধুদের জানালেও তুষারের আপত্তিকর আলাপের বিষয়টি নিয়ে উচ্চকিত হইনি, বরং সাংগঠনিকভাবে গোপনীয়তার সাথে বিষয়টি ডিল করার চেষ্টা করি।
কিন্তু তুষার আমাকে সেই সুযোগ দেয় নাই। বিষয়টি আমার প্রফেশনাল লাইফে প্রভাব ফেলে।
সে আমার সহযোগীদেরকে বলা শুরু করে, “নীলার থেকে দূরে থাকতে হবে। ”
সে আমাকে এনসিপি থেকে দূরে রাখতে, আমাকে বিভিন্ন সেল থেকে দূরে রাখতে, সাংস্কৃতিক সেল, নারী উইং, মহানগর কমিটি থেকে দূরে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটাতে থাকে।
কোরবানির দিন রাতে একটি অনুষ্ঠানে নাহিদের সাথে দেখা হয় এবং নাহিদকে বিষয়টি জানাই।
নাহিদ আমাকে বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলার দিক থেকে ডিল করতে ও মহানগরে দায়িত্বে থাকা শাহরিয়ার ও নিজামকে বিষয়টি অবগত করতে বলে।
যে দিন সন্ধ্যায় শাহরিয়ার ও নিজামকে আমি জানাই, তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি যে, অডিওটি কেটে সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে এবং ভাইরাল হয়েছে।
এরপর আমাকে নিয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হয়, তাতে আমি দেখতে পেয়েছি, আমার নারী সহকর্মীরাও আমার পক্ষে দাঁড়ায় নাই।
আমার অপরাধ আমি পাশ্চাত্য কাপড় পরি। আমি ‘তুমি’ করে কথা বলি, সহজভাবে সবার সাথে মিশি।
আমাকে নিয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে, সেটা আমি সহ্য করব।
আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে অনেক কঠিন সময় দিয়েছেন।
কিন্তু আমার সহকর্মীরা বুঝতে পারছেন না, তুষার যদি আমার মতো একজন সাহসী নারীকে এইভাবে যৌন নিপীড়ন ও সাংগঠনিক প্রভাব খাটিয়ে দমন করার সুযোগ পায়, তবে আগামী দিনে তারাও নিরাপদ থাকবে না।
তাদেরকে আমার চেয়ে কঠিন নিপীড়নের শিকার হতে হবে।
সবাই নীলা ইসরাফিল নয়—
যাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির না করে ৩৫ সপ্তাহে প্রেগ্নেনসি ৩৭ দিন কারাগারে রেখে বাচ্চার হওয়ার পর শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেওয়ার পররেও শ্বশুরবাড়ির সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে, রাস্তায় গিয়ে প্রতিবাদ করবে, বাংলাদেশের পুরো বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে একলা লড়বে।
আমার খারাপ লাগে এনসিপির জন্য।
আমি এনসিপিকে ভালোবাসি।
আমি ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখেছি, তাদের শত ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু তারা প্রকৃতই দেশকে ভালোবাসে।
আমার কারণে এনসিপি আজ কলঙ্কিত হলো, তাদের ট্রায়ালে পড়তে হলো।
কিন্তু আমাকে আল্লাহ অন্যায়ের মুখে চুপ করে থাকার শক্তি দেননি।
আমি তুষারের কোনো ক্ষতিও চাইনি।
আমি পার্টির ভেতরে বিষয়টা মীমাংসার চেষ্টা করেছি, চেয়েছি তুষার একটা ইন্টারনাল শাস্তি পেয়ে শুদ্ধ হোক।
আমার মতো আর কোনো নারী যেন পার্টির ভেতরে তুষার বা তুষারের মতো কারও লালসার শিকার না হয়।
এনসিপি ভদ্রলোকদের দল—এখানে যেন ভদ্র নারীরা নিরাপদে বিচরণ করতে পারে।
অনেকে বলেছেন, আপনি দ্বিতীয় ভিডিওটা কেন করলেন?
কিন্তু আমার অডিও প্রকাশের পর আমাকে যা ফেস করতে হয়েছে—
আমি সিডিওস করেছি, আমি কেন ‘তুমি’ করে কথা বলি, নিশ্চয়ই আমি পদ-পদবির লোভে ঢলে ঢলে মিশে, তারপর পদ-পদবি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে এই সব প্রকাশ করেছি—এই সব অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
কেউ আমাকে বিশ্বাস করেনি।
আমার সহকর্মীদের কেউ আমাকে ফোন করে একটু সহানুভূতি জানায়নি, যেন আমি অপরাধী আর তুষার ভিকটিম।
বিথি তার ইস্যু এখনো ডিল করতে পারেনি, তাই আমি সচেতনভাবেই রেকর্ড করেছি; যিনি প্রতিদিন গাইড করেন, তিনি যদি সেই দিন দেশে থাকতেন, হয়তো আমি এই অডিওটা বা তার পরের অডিও প্রশ্ন-উত্তরটা প্রকাশ করার অনুমতি দিতাম না। হয়তো ভুল করেছি। হয়তো ভুল করিনি।
আমার তাসনুভার জন্য খারাপ লাগছে। ওর কোনো অপরাধ নেই। আমার কারণে তাকে একটা ঘৃণ্য সময় পার করতে হলো।
এই ছাড়া আমার কোনো গিল্টি ফিলিং বা কোনো রিগ্রেট নাই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রাক্তন স্বামী, হাসান আরিফ বা তুষারের সাথে আমার প্রতিটা ঘটনা যদি রেকর্ড করে সবার সামনে ফাঁস করা হতো, তাহলে আপনারা দেখতে পেতেন—
আমি জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে আসা চরিত্র আর সতীত্বের পরীক্ষায় পাশ করে আসা একজন নারী।
আপনাদের পরীক্ষায় পাশ ফেল করা না করায় আমার কিছুই যায় আসে না।
এই বিষয়ে এইটা আমার ফাইনাল বক্তব্য। আমি এই নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাইনা। বাকি যা বলার আমি তদন্ত কমিটিকে বলবো।
আমি এই ঘটনাটি পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’