ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা: তিন দশকেও শেষ হয়নি বিচার


২৪ জানুয়ারী ২০১৯ ২২:০৯

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ২১:২১

শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা: তিন দশকেও শেষ হয়নি বিচার

চট্টগ্রাম ব্যুরো: সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার পর দায়ের হওয়া মামলার বিচার তিন দশকেও শেষ হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কিছুদিন বিচার কাজে গতি এসেছিল। তবে সম্প্রতি প্রধান আসামি মির্জা রকিবুল হুদার মৃত্যুর তদন্ত প্রতিবেদন জমা নিয়ে আবারও ঝিমিয়ে পড়েছে বিচারকাজ।

বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত এই ঘটনার ৩১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তিন দশক ধরে মামলা চলতে গিয়ে আটজন আসামির মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একজন পলাতক আছেন এবং চারজন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। ওই আদালতের বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৭ সালের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলেছিলেন। এরপরও দুইবছর পেরিয়ে গেছে- বিচার শেষ হয়নি।

মেজবাহ সারাবাংলাকে জানান, মামলার প্রধান আসামি সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা মারা গেছেন বলে তার আইনজীবী গত বছরের জুলাই মাসে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশে সিএমপির বিশেষ শাখা থেকে সত্যতা তদন্ত করে ৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়।

বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. আব্দুল ওয়ারিশ খান প্রতিবেদনে জানান, স্ত্রীর মৃত্যুর পর রকিবুল হুদা ‍যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানদের কাছে চলে যান। তার চাচাত ভাই ইমন মির্জা জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন। তবে তিনি মৃত না জীবিত সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আদালতে আবেদন করে। এ বিষয়ে আদালতের আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৌঁছেছে। তবে মামলার ধার্য তারিখ গত ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেদনটি আদালতে আসেনি। এতে সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ হয়ে আছে।

মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল সাক্ষী আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী ও তোফায়েল আহমেদ সাক্ষী হিসেবে আছেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে এই বছরের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।

মামলার ১৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিপি মেজবাহ।শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা: তিন দশকেও শেষ হয়নি বিচার

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নগরীর লালদিঘি ময়দানে সমাবেশে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে নিহত হন ২৪ জন। আহত হন কমপক্ষে দু’শতাধিক মানুষ।

নিহতরা হলেন, হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মো. শাহাদাত।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে প্রয়াত আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকাণ্ডের সময় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনারের দায়িত্বে থাকা মির্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়। এতে রকিবুল হুদাকে ‘হত্যার নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বহুল আলোচিত মামলাটি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের নির্দেশে সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাকে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে মির্জা রকিবুল হুদাসহ ৮ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, কোতোয়ালী জোনের তৎকালীন পেট্রল ইনস্পেকটর (পিআই) জে সি মন্ডল, পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মো. আব্দুলাহ এবং মমতাজ উদ্দিন।

আদালতে দুই দফায় আলোচিত এ মামলার চার্জ গঠন (দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত আকারে) করা হয়। প্রথম দফায় ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট এবং দ্বিতীয় দফায় ২০০০ সালের ৯ মে ৮ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/৩২৬/৩০৭/১১৪/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।

আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০০০ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর ২০০১ সালের ১৭ মে থেকে ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাত্র দু’জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক বছরে সাক্ষ্যগ্রহণ হয় ১৩ জনের। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ওই বছরের ২৫ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা হাফিজ উদ্দিন দেওয়ানের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। এরপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারিক আদালত চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আর কোনো সাক্ষীকে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

এই অবস্থায় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি মামলাটি বিচারের জন্য আসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসার পর ১১ জন সাক্ষ্য দেন। ২০১৬ সালের ২৬ জুন সাক্ষ্য দেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

এরপর নিহতের মা শেফালী সরকার, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, সুভাষ চন্দ্র লালা, নিহতের ভাই অশোক কুমার বিশ্বাস, নিহতের মা হাসনা বানু, নিহতের ভাই মাঈনুদ্দিন, আবু সৈয়দ এবং অশোক বিশ্বাস সাক্ষ্য দেন।

‘চট্টগ্রাম গণহত্যা: প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি’ শীর্ষক বইয়ের লেখক সাংবাদিক নিরুপম দাশ গুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি চালানো হয়েছিল। ২৪ জন মানুষ মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন। এই ঘটনার বিচার অনেক আগেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বজন হারানো মানুষগুলোকে শান্তি দেওয়ার জন্য হলেও বিচার দ্রুত শেষ হওয়া দরকার ছিল।