ভয়ে বিদেশে পালানোর পথ খুঁজছে কারবারিরা
‘ইয়াবা সাইফুল’ নিহত হওয়ায় টেকনাফে পরিস্থিতি বদল

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা কারবারির তালিকায় দুই নম্বরে থাকা সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের দৃশ্যপট বদলে গেছে। এই ‘ইয়াবা ডনের’ মৃত্যুতে সীমান্তের মাদক কারবারিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সীমান্তের অন্যান্য ‘ডন’ও। কানাঘুষা শুরু হয়েছে, ইয়াবা ডনদের অনেকে গোপনে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
এদিকে মাদক কারবারিরা আতঙ্কে থাকলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতেও সীমান্ত দিয়ে আসছে লাখ লাখ ইয়াবা বড়ির চালান। শনিবার রাতেও পাচারকারীদের সঙ্গে গোলাগুলির পর ৯ লাখ ৬২ হাজার পিস ইয়াবার একটি বিশাল চালান উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা ডন সাইফুল করিম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রতি স্থানীয় সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। টেকনাফে এ পর্যন্ত শতাধিক ইয়াবা কারবারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। তবে তাদের কেউই সাইফুল করিমের মতো এমন রাঘব বোয়াল ইয়াবা কারবারি ছিল না।
টেকনাফ সদরের তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা গুরা মিয়া বলেন, ‘এলাকার মানুষের ধারণা ছিল, সাইফুল করিমদের মতো ইয়াবা ডনরা বরাবরের মতোই অক্ষত থেকে যাবে। গত বৃহস্পতিবার রাতের বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল করিম নিহত হওয়ার ঘটনায় জনমনের সেই সন্দেহ দূর হয়েছে। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণাও পাল্টেছে।’
টেকনাফ পৌর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী গতকাল রবিবার বলেন, এত দিন মানুষের মুখে মুখে ছিল, শুধু চুনোপুঁটিরাই বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়। এবার সাইফুল করিম নিহত হওয়ার ঘটনা সীমান্তের মাদক কারবারিদের জন্য এক মহাপ্রলয়ংকরী বার্তা বলে মনে করছে এলাকার লোকজন। এ কারণে টেকনাফের প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারিরা বিদেশে পালানোর পথ খুঁজছে বলে বলাবলি হচ্ছে। এরই মধ্যে টেকনাফ শহর থেকে গাঢাকা দেওয়া ইয়াবা কারবারির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির কনিষ্ঠ ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সীমান্তের একজন অঘোষিত ইয়াবাসম্রাট। অভিযোগ রয়েছে, মৌলভী মুজিবুরের সিন্ডিকেটে কয়েক শ পাচারকারী রয়েছে। তারা মৌলভী মুজিবুরের প্রভাবে ইয়াবা পাচার করে থাকে। মৌলভী মুজিবুর একদিকে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই এবং বর্তমান এমপি শাহীন আকতারের দেবর। অন্যদিকে তিনি টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র এবং ইসলামী ঐক্যজোট ও হেফাজতের নেতা। এসবের প্রভাব নিয়েই দীর্ঘকাল ধরে তিনি টেকনাফ সীমান্তের অন্যতম ইয়াবা গডফাদার হিসেবে কারবারে জড়িত রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌলভী মুজিবুর টেকনাফ থেকে গাঢাকা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায় তাঁর এক ডজনের মতো ফ্ল্যাট রয়েছে। অন্যদিকে এমপি বদি সিন্ডিকেটের অন্যতম ইয়াবা ডন এবং টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, ইয়াবা কারবারি আবদুল্লাহ, আবদুল গফুর, কাউন্সিলর মনিরুজ্জামানসহ আরো অনেকেই গাঢাকা দিয়েছে। এদের বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে দুবাই পাড়ি জমিয়েছে বলেও জানা গেছে। অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমন কথাবার্তাও এলাকায় চাউর হয়েছে।
এক বছর ধরে ইয়াবাবিরোধী অভিযানেও টেকনাফ সীমান্তে তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়নি, যেমনটা সাইফুল নিহত হওয়ার পর গত তিন দিনে হয়েছে। কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই টেকনাফ পৌর শহর ফাঁকা হয়ে যায়। বাজারে লোকসমাগমও আগের মতো নেই। শত শত মোটরবাইক নিয়ে ইয়াবা কারবারিদের মহড়াও আর দেখা যাচ্ছে না। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, সীমান্তে ইয়াবা কারবারিদের উৎপাত কমে গেছে।
এদিকে শনিবার রাতেও টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা পাচারকারীদের সঙ্গে বিজিবির গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় পালিয়ে যাওয়া পাচারকারীদের নৌকা থেকে ইয়াবার একটি বড় চালান আটক করে বিজিবি।