হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে
কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ,কচ্ছপগতিতে দুর্নীতির তদন্ত

রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত হাবীবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা লুট এবং শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির কার্যক্রম কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি তদন্তে কলেজ কর্র্তৃক গঠিত কমিটির প্রধান পরিবর্তন হলেও গত আট মাসে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি তারা।
এখন পর্যন্ত নেই কোনো কার্যকর অগ্রগতিও। গতকাল সোমবার পর্যন্ত কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি অধ্যাপক ড. সাজাহান মিয়া। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) শিক্ষকদের করা অভিযোগেরও কোনো সুরাহা হয়নি। এদিকে টানা ১০ মাস শিক্ষকদের বেতনভাতা বন্ধ অন্যদিকে কর্র্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় শিক্ষকরা গত শনিবার থেকে কলেজ অধ্যক্ষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার অপসারণ দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন। অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে টানা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে আজ (মঙ্গলবার) গভর্নিং বডির মিটিং ডাকা হয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার অপসারণ দাবিতে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। দাবি না মানলে আরও কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে শিক্ষকদের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১৫ জুন ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে গভর্নিং বডি। সে কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কলেজটির ৭৪ জন শিক্ষক গত বছর ১ নভেম্বর দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) অভিযোগ দিয়েছেন। তারও কোনো সুরাহা হয়নি। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজ গভর্নিং বডি ও ডিআইএতে করা শিক্ষকদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে আর্থিক আয়-ব্যয়ে কোনো ধরনের স্বচ্ছতা নেই। শিক্ষার্থীদের বেতন নগদে নিয়ে আত্মসাৎ, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির স্কেলে বেতন দেওয়া, কলেজ উন্নয়নে বিভিন্ন কেনাকাটায় বাজার দরের চেয়ে চারগুণ বেশি খরচ দেখানো, খরচ না করেও ভুয়া বিল ভাউচারে টাকা উত্তোলন, কলেজের টাকায় নিজের বাসার সাজসজ্জা, অধ্যক্ষ চার নম্বর বেতন গ্রেডে বেতন না নিয়ে এক নম্বর গ্রেডে বেতন নেওয়া এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা প্রভৃতি।
ডিআইএ গঠিত কমিটির তদন্ত চলমান রয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, কলেজের শিক্ষক নিয়োগে কিছু অনিয়ম ও ভুয়া বিল ভাউচারের বিষয়ে তথ্য পেয়েছে ডিআইএ। তবে এ তদন্তের প্রতিবেদনও এখনো প্রকাশ করেনি। ধীরগতিতে তদন্ত চলায় হতাশ হয়ে পড়েছেন শিক্ষকরা। তদন্তের মূল দায়িত্বে থাকা ডিআইএ’র শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগ বলেন, ‘আমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৫ দিনের মতো কাজ করতে পারিনি। তবে আমাদের তদন্ত অব্যাহত আছে। আশা করছি দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’
এ বিষয়ে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাজাহান মিয়া বলেন, ‘যে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা এক দিনের নয়। আমি সবাইকে বলেছি কোনো ধরনের অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গভর্নিং বডির মিটিং আহ্বান করতে বলেছি। দুয়েক দিনের মধ্যে মিটিং। সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে।’ অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমিটি এখনো কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এর মাঝে শিক্ষকরা ডিআইএতেও অভিযোগ করেছেন। সেখান থেকে কী প্রতিবেদন আসে তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়টি জেনেছি। তবে প্রিন্সিপাল (অধ্যক্ষ) আমাকে কিছু জানাননি। আমি প্রিন্সিপালকে বলেছি, আপনি শিক্ষকদের কাছে যান, কথা বলেন। সবাইকে মিলেই কলেজটাকে রক্ষা করতে হবে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার মিয়াকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ না করে বারবার কেটে দেন।
দেশে করোনার বিস্তাররোধে মার্চের শুরুতেই বন্ধ করা হয় কলেজের ক্লাস। এরপরই বেতন নিয়ে বিপাকে পড়েন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনকি গত দুই ঈদেও বেতন-বোনাস পাননি তারা। জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী কলেজটিতে বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু বেতন চাইলে অধ্যক্ষ সাফ জানিয়ে দেন, কলেজের ফান্ডে টাকা নেই। এমনকি শিক্ষকদের তিনি বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে না জানাতে নির্দেশ দেন।
এ পরিস্থিততে কলেজ অধ্যক্ষ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তোলেন শিক্ষকরা। বিষয়টি তদন্তে গত বছর ১৫ জুন ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে গভর্নিং বডি। এর মাঝে একবার কমিটির প্রধান পরিবর্তন করা হয়েছে। তবুও কোনো অগ্রগতি নেই কমিটির কার্যক্রমের। টানা আট মাস বেতন বন্ধ থাকার পর গত নভেম্বর থেকে সীমিত আকারে থোক বরাদ্দের টাকা পাচ্ছেন কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
আর্থিকভাবে সাবলম্বী কলেজটির এমন পরিণতিতে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা বলছেন, কলেজের সাবেক ও বর্তমান অধ্যক্ষ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং পরিচালনা বোর্ডের সাবেক এক সভাপতির প্রত্যক্ষ সহায়তায় কলেজের ফান্ডের টাকা লুট করা হয়েছে। এরপরও স্বপদে বহাল রয়েছেন বর্তমান অধ্যক্ষ ড. আবদুল জব্বার মিয়া। তার সহায়তায় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ (কিছুদিন আগে মারা গেছেন) নিয়মবহির্ভূতভাবে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন। এছাড়া গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য ক্যাসিনো খালেদকে কলেজের বার্ষিক বনভোজনে কলেজের ফান্ডের টাকায় সোনার থালা, চামচ ও নৌকা দিয়েছেন বর্তমান অধ্যক্ষ। ভুয়া ভাউচার আর উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও বাণিজ্য হয়েছে। এসব অভিযোগ তুলে কলেজ অধ্যক্ষ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যদের অপসারণ এবং বিচার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নেমেছেন তারা।