সাতক্ষীরার চরে বিএসএফের ফেলে যাওয়া ৭৮ জন যে বর্ণনা দিলেন

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের ফেলে যাওয়া ৭৮ জন ‘বাংলাভাষীকে’ উদ্ধার করে শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করেছে কোস্টগার্ড।
তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে ভারতের গুজরাটে কাজের জন্য গিয়েছিলেন তারা। গত ২৬ এপ্রিল দেশটির পুলিশ তাদের আটক করে। এরপর ৯ মে বাংলাদেশে ফেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ‘মারধর’ করাসহ নানাভাবে ‘অমানবিক আচরণ’ করা হয়।
রোববার বিকালে তাদের মান্দারবাড়িয়া থেকে প্রথমে কোস্টগার্ড মংলা ক্যাম্পে নিয়ে যান কোস্টগার্ডের সদস্যরা। সেখান থেকে সন্ধ্যায় রওনা হয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় নেওয়া হয় রাতে।
শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রনি খাতুন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাত ১২টায় উপজেলা প্রশাসন ও শ্যামনগর থানা পুলিশ ৭৮ জনের দায়িত্ব বুঝে নেয়।
শ্যামনগর থানার ওসি হুমায়ুন কবির মোল বলেন, “ভারতের ঠেলে দেওয়া (পুশ ইন) বিভিন্ন বয়সী ৭৮ জন ব্যক্তিকে শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চর থেকে উদ্ধার করা হয়। তারা সবাই অসুস্থ ছিলেন। রাতেই তাদের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।”
এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধারদের মধ্যে তিনজন নিজেদের জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক বলে দাবি করেছেন; তাদের মা-বাবাও ভারতীয়।
“ওই তিনজনের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা করা হবে। আর বাকি ৭৫ জন নিজেদের বাংলাদেশি বলে দাবি করেছেন। তাদের অধিকাংশের বাড়ি নড়াইল, খুলনা, ঢাকা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বলে জানা গেছে।”
বাংলাদেশি দাবি করা ৭৫ জনকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপেক্সে এবং বাকি তিনজনকে শ্যামনগর থানায় রাখা হয়েছে বলে শ্যামনগর থানার ওসি জানান।
গত ২৭ এপ্রিল ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদ ও সুরাট শহরে নারী ও শিশুসহ এক হাজার ২৪ বাংলাদেশিকে আটকের তথ্য দেয় রাজ্য পুলিশ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘হিন্দুস্তান টাইমসে’ এ নিয়ে খবর প্রকাশ করা হয়।
পরদিন আহমেদাবাদে সংবাদ সম্মেলনে এসে রাজ্য পুলিশের প্রধান বিকাশ সহায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেলের নির্দেশনায় এক রাতের অভিযানে আহমেদাবাদ থেকে ৮৯০ বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। ১৩৪ জনকে ধরা হয় সুরাট থেকে। অনুপ্রবেশ কিংবা অনুপ্রবেশকারীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় এ অভিযান জরুরি ছিল।”
এরপর থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ বহু মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে (পুশ ইন) দিচ্ছে বলে খবর আসতে থাকে।
এই ‘পুশ ইনের’ মধ্যেই মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে ফেলে যায় বিএসএফ। প্রথমে তাদের কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করে বন বিভাগ। পরে কোস্টগার্ড তাদের থানায় নিয়ে যায়।
কীভাবে মান্দারবাড়িয়া চরে ফেলে যাওয়া হয়েছে, সেই বিবরণ উদ্ধার ব্যক্তিদের কয়েকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছেন।
তারা হলেন নড়াইলের বিষ্ণুপুর গ্রামের খোষাল শেখের ছেলে রউফ শেখ (৭৬), বাবুপুর গ্রামের মান্দার শেখের ছেলে শেখ শওকত (৪৫) এবং খুলনার দৌলতপুর উপজেলার মহেশ্বরপাশা গ্রামের আমজেদ বেপারীর ছেলে মোহাম্মদ ইমরান (৫৬)।
রউফ, শওকত ও ইমরান বলেন, তারা সবাই ভারতের গুজরাটের সুরাট বস্তিতে থেকে ছোটখাট কাজ করে জীবিকা চালাতেন। গত ২৬ এপ্রিল স্থানীয় প্রশাসন তাদের বস্তি গুঁড়িয়ে দেয় এবং ওইদিন রাতেই তাদের আটক করা হয়।
সেখান থেকে তাদের হাত ও চোখ বেঁধে নেওয়া হয় পুলিশ ক্যাম্পে। সেখানে চার দিন রাখার পর বিমানে করে আনা হয় কলকাতায়। সেখান থেকে তাদের জাহাজে করে এনে গত ৯ মে বঙ্গপোসাগরের তীরবর্তী মান্দারবাড়িয়া এলাকায় নিয়ে চোখ বেঁধে একটি চরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তারা হেঁটে বনবিভাগের মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেন।
রোববার কোস্টগার্ড তাদের মোংলায় নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। পরে তাদের নাম-পরিচয় নিয়ে রাতেই শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করে।
বাংলাদেশি হলেও দীর্ঘদিন ধরে গুজরাটে বসবাস করে আসছিলেন বলে উদ্ধার পাওয়া এই ব্যক্তিদের ভাষ্য।
তারা বলছেন, ২৬ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ‘অমানবিক’ আচরণ করা হয়েছে। তাদের ঠিকমত খেতে দেওয়া হত না। মাঝেমধ্যে ‘মারধর’ করা হত। এছাড়া সবসময় ‘গালিগালাজ’ করা হত।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) মশিউর রহমান বলেন, “প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে ৭৮ জন বাংলাভাষীকে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করা হয়। পরে তাদের ভারতীয় একটি জাহাজ ও স্পিডবোটে করে গত ৯ মে বঙ্গপোসাগরের এলাকার একটি চরে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তারা মান্দারবাড়িয়া টহল ফাঁড়িতে আশ্রয় নেন।”
মান্দারবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ওসি মোবারক হোসেন বলেন, তার ফাঁড়িতে তিন দফায় মোট ৭৮ জন মানুষ আশ্রয় নেয়। শুরুতে ৩২ জন আসেন, পরে আরও দুই দফায় ৪৬ জন হেঁটে ফাঁড়িতে পৌঁছান।
এদিকে ভারতীয় নাগরিক দাবি করা তিনজনের ভাষ্য, তাদের বাবা-মা গুজরাটে থাকাকালে সেখানেই তাদের জন্ম হয়। তাই জন্মসূত্রে তারা ভারতীয় নাগরিক। তাদের কাছে সব ধরনের কাগজপত্র ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে ভারত সরকার তাদের কাগজপত্র নিয়ে নেয়।
শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রনী খাতুন বলেন, “আকস্মিকভাবে ৭৮জনকে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী নির্জন চরে ফেলে যাওয়ার ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছে। তাদের নাম-পরিচয় ও ঠিকানা শনাক্তের পাশাপাশি তাদের সুস্থ রাখার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার, চাল, ডাল ও পানিসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।”
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কালিগঞ্জ সার্কেল) মিথুন সরকার বলেন, “৭৮ জন ব্যক্তি যে পরিচয়ই দিক না কেনো, তাদের তথ্যগুলো যাচাই করা হবে।”
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম