ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৩রা জুলাই ২০২৫, ২০শে আষাঢ় ১৪৩২


স্ত্রীর দেয়া বাইকে প্রেমিকা নিয়ে ঘুরছেন স্বামী; বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় অন্তঃসত্তা অসহায় স্ত্রী


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২৫ ২৩:০৯

মনিরুজ্জামান মনি

গত ২০২৪ সালের ২৮ জুন যশোরের হাবিবুর রহমানের সাথে বিয়ে হয় সাতক্ষীরার পিংকি খাতুনের সাথে। সুখে সংসারও হয় বেশ কয়েক মাস। সেই সংসারে হঠাৎ জুড়ে বসে মাদক, জুয়া আর পরোনারী আসক্তির কালো থাবা। সংসার রক্ষায় সবকিছু মেনে নিয়ে সুখের আশায় স্বামীর ব্যবসার উন্নয়নে দিয়েছেন লক্ষাধিক টাকা, মোটরসাইকেল, স্বর্ণালঙ্কার আর দামি দামি আসবাবপত্র। কিন্তু তাতেও মন ভরেনি নারীলোভী পাষন্ড স্বামীর। অন্যত্র মজেছেন পরকিয়া প্রেমে। বার বার হত্যার চেষ্টা করেছেন স্ত্রীসহ স্ত্রীর গর্ভে থাকা নিজের সন্তানকে।’

বুধবার (০২ জুলাই) দুপুরে সাতক্ষীরা বিজ্ঞ আমলী ০৮নং আদালতের বারান্দায় বসে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন আশাশুনি উপজেলার আদালতপুর (দুর্গাপুর) গ্রামের মৃত জাহাঙ্গীর সরদারের মেয়ে ৮ মাসের অন্তঃস্বত্ত¡া পিংকি খাতুন। তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেছেন নিজের স্বামী যশোরের বাঘারপাড়ার খালসি গ্রামের আক্কাচ আলীর ছেলে হাবিবুর রহমানসহ তার শ^শুর, শ^াশুড়ি ও স্বামীর বন্ধুর বিরুদ্ধে। স্বামী সংসারে নির্যাতিত ভুক্তভোগী অন্তঃস্বত্ত¡া নারী পিংকি খাতুন জানান, ‘ইসলামী শরিয়াত মোতাবেক ৪ লক্ষ টাকার দেন মোহর ধার্য্যে আমাদেও বিয়ে হয়। বিবাহ পরবর্তী আমার স্বামীর বাড়িতেই আমি সুখে শান্তিতে সংসার করে আসছিলাম। আমি যাতে আমার স্বামী সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারি সেই কথা বিবেচনা করে বিয়ের দুই মাসের মাথায় আমার মা আমার স্বামীর ব্যবসায়িক কাজে লাগানোর জন্য নগদ ২ লাখ টাকা দেয়। এছাড়া আমার সুখের কথা চিন্তা করে আমার স্বামীকে ১টি স্বর্নের আংটি, ১টি স্বর্নের চেইন, ১টি ইঞ্জিন ভ্যান ও আমাকে ১টি স্বর্নের চেইন, ১ জোড়া স্বর্নের রুলি, ১ জোড়া স্বর্নের কানের দুলসহ সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র ফ্রিজ, টিভি, আলমারী, শোকেজ, ড্রেসিং, টেবিল, ওয়ার্ড ড্রপার, চেয়ার, সিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান উপহার স্বরুপ প্রদান করেন।’

ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ আরো জানান, ‘ভালই চলছিলো আমদের সংসার জীবন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিবাহের কয়েকমাস যেতে না যেতেই আমি জানতে পারলাম আমার স্বামীর পরোনারী আসক্তি, মাদক ও জুয়ারর নেশা রয়েছে। জানতে পারলাম যশোরের চৌগাছার জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত নামের এক নারীর সাথে পরোকিয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন আমার স্বামী হাবিবুর রহমানের। পরবর্তীতে কৌশলে ওই নারীর সাথে কথা বলে জানতে পারি তিনি আমার স্বামীর পুরোনো প্রেমিকা এবং বর্তমানে অন্যের স্ত্রী। এছাড়াও আরো কয়েকজন মেয়েদের সাথে আমাকে গোপন করে নিয়মিত যোগাযোগ করে আসছে সে’।

ওই গৃহবধূ পিংকি জানান, ‘প্রায় সময় স্বামী হাবিবুর রহমান তার কাছের বন্ধু রেজার সাথে নেশা করে গভীর রাতে বাড়ি ফেরে। স্বামীর এসব অপকর্মের বিষয়ে শ^শুর মোঃ আক্কাচ আলী এবং শাশুড়িকে জানালে তারা নিজের ছেলের অপরাধ ঢাকতে আমাকে বিভিন্ন ধরনের অপবাদ দিয়ে সংসারে অশান্তি করাসহ আমাকে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে পরিবারের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ সৃষ্টি হয়। এনকি আমার স্বামী আর তার বন্ধু একই এলাকার গফুর মোল্যার ছেলে রেজার মাদক সেবনের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে প্রায় সময় আমার স্বামী তার বন্ধুকে সাথে নিয়ে আমার স্বামী নিজ গৃহে মাদক সেবন করা শুরু করে। এতে আমি বাধা দিতে গেলে আমাকে প্রায় সময় মারধর করাসহ আমাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দিতে থাকে।’

অসহায় ওই গৃহবধূ জানান, ‘আমি পিতৃহারা একজন অসহায় নারী হিসেবে স্বামীর সাথে সংসার করার তাগিদে সবকিছুই অতিকষ্টে মেনে নিলেও তারা আমার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। আমার স্বামী, শ^শুর-শাশুড়ি এবং তার বন্ধুর পরামর্শে আমাকে বলে সংসার করতে হলে আমাকে আরও ৫ লাখ টাকা দিতে হবে, আমি নতুন ব্যবসা করবো। টাকা না দিলে তোকে তালাক দিয়ে আরেকটি বিয়ে করবো। সেখান থেকে যৌতুকের টাকা নিয়ে কোটে টাকা দিলে তোর কিচ্ছু করার নেই। দিনের পর দিন আমার স্বামীর সকল অত্যাচার সহ্য করে অতিকষ্টে সংসার করছিলাম। আমি অনেকবার হাতে পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করেছি, তবুও সে তার পথ থেকে ফিরে আসেনি।’

পিংকি খাতুন জানান, ‘এমন পরিস্থিতিতে আমার স্বামীকে খুশি করার জন্য আমার চাকরি জীবনের নিজ উপার্জিত সংরক্ষিত ২ লাখ টাকা দিয়েছিলাম মোটরসাইকেল কিনতে। মোটরসাইকেল কিনেছেন ঠিকই কিন্তু আমি কোনদিন ওই মোটরসাইকেলে চড়তে পারিনি। অথচ তার পরোকিয়া প্রেমিকাকে নিয়ে সে ঘুওে বেড়াচ্ছে আর আমি পেটে তার ঔরষের ৮ মাসের সন্তান নিয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরছি।’

ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ আরো জানান, ‘আমার গর্ভধারনের কথা জানতে পেরে আমার স্বামী এবং শ^াশুড়ি আমার গর্ভপাতের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ কওে আসছে। বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে বেধড়ক মারপিট সহ আমার গর্ভের সন্তান নষ্ট করার চেষ্টা করে আসছে। এরআগে আমি ৬ (ছয়) মাসের অন্তঃস্বত্তা থাকাকালীন আমার অসহায়ত্বকে পুঁজি করে আমার স্বামী তার মা-বাবা ও বন্ধুর উস্কানিতে আমার মায়ের নিকট থেকে তার দাবীকৃত ৫ লাখ টাকা আনতে আমাকে চাপ প্রয়োগ সহ শারীরিক ভাবে নির্যানতন অব্যাহত রাখে। ফলে বিভিন্ন সময়ে আমাকে ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তারপরও আমি আমার স্বামীকে অসৎ জীবন থেকে সরে এসে সংসারের মনোনিবেশ করার জন্য অনুরোধ অব্যাহত রাখি। কিন্তু যৌতুক লোভী স্বামী তার পিতা-মাতা সহ অসৎ বন্ধুর পরামর্শে দিন দিন আমার উপর আরো নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও অমানুষিক ভাবে মারপিট করা শুরু করে। আমার নিজ অসহায়ত্ব ও গর্ভের সন্তানের কথা চিন্তা করে আমার স্বামীর সকল নির্যাতন সহ্য করে সংসার করতে থাকি।

এছাড়াও সংসার করাকালীন সময়ে আমার স্বামী কৌশলে আমার চাকরি জীবনে উপার্জিত সংরক্ষিত অর্থ মার্কেনটাইল ব্যাংক থেকে জ্বাল জালিয়াতি করে অ্যাপস এর মাধ্যমে ৫ লাাখ ৭৫ হাজার টাকা গোপনে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি আমি জানতে পারলে আমাকে বেধড়ক মারপিট করে চুপ করিয়ে রাখে। এসব বিষয়ে আমি আমার মাকে জানালে আমার মা গত ঈদুল ফিতরের পরদিন আমার স্বামীর বাড়িতে যায়। আমার মা যাওয়ার পর আমাকে মারধর করে আমার মাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার মায়ের কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমার স্বামী বলে বাপের বাড়িতে গিয়ে সেই ৫ লাখ টাকা রেডি কর, আমরা আসছি। সেদিনই বিকেল ৫টার দিকে আমার মায়ের সাথে আমি পিতার বাড়ীতে চলে আসি। সেই রাতেই আমার স্বামী শ^শুর এবং স্বামীর বন্ধু রেজা আমার বাবার বাড়িতে আসে। স্বামী সংসারের কথা ভেবে রাতে তাদের অতিথির ন্যায় খাওয়া দাওয়া ও আপ্যায়ন করি। পরদিন ০৩/০৪/২০২৫ তারিখে সকাল ১০টার দিকে আমার স্বামী তার পিতা ও বন্ধুর সক্রীয় সহযোগীতায় আমার মায়ের নিকট তার দাবীকৃত ৫ লাখ টাকা চাইলে আমি এর প্রতিবাদ করি। তখন আমার স্বামী হাবিবুর রহমান আমার শ^শুর ও স্বামীর বন্ধু রেজার পরামর্শ ও উস্কানিতে তার পাশে থাকা বাঁশের চটা দিয়ে আমাকে এলোপাতাড়ী ভাবে আঘাত আমাকে রক্তাক্ত জখম করে। এসময় সময় শ^শুর ও স্বামীর বন্ধু রেজা আমাকে গালিগালাজ করে টাকা চাওয়াসহ আমাকে চড়, কিল, ঘুষি, লাথি মারে। এসময় আমি ডাকচিৎকার দিলে আমার স্বামী আমার গলা দুই হাত দিয়া চেপে মাটিতে ফেলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার চেষ্টা করে আর বলে তোকেসহ তোর পেটেরটাও শেষ করে দিবো। তখন আমার মা সহ প্রতিবেশিরা এগিয়ে আসলে তারা মারধর করা থামিয়ে দেয়। এসময় উপস্থিত প্রতিবেশীরা মারপিটের কারণ জানতে চাইলে আমার স্বামী তাদের জানায়, আমার নগদ ৫ লাখ টাকা না দিলে আমার স্ত্রীকে আর নিয়ে যাবো না। এমনকি ভরন পোষন ও তার প্রাপ্য দেন মোহরের টাকা দেবো না। এছাড়া এতদিন পর্যন্ত যত মালামাল, স্বর্নালংকারাদী ও ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দিতে পরবো না বলে আমাকে তালাক দিয়ে অন্যত্রে মোটা অংকের যৌতুকের টাকা নিয়ে বিয়ে করার কথা জানিয়ে আমার দেওয়া মোটরসাইকেল যোগে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

পরবর্তীতে আমাকে আমার মা প্রতিবেশীদের সহযোগীতায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করায়। আমি গত ইং- ০৩/০৪/২০২৫ তারিখ থেকে গত ইং-১৩/০৪/২০২৫ তারিখ পর্যন্ত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর স্থানীয় লোকজন সহ আমার মা তাদের সাথে মিমাংসা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিবাহের কাবিন নামা সংগ্রহ করে স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে গত ইং-২৮/০৪/২০২৫ তারিখে সকাল ১০টায় বিজ্ঞ আমলী ০৮নং আদালত, সাতক্ষীরাতে গত ১১-০৬-২০২৫ তারিখে সি/আর ১৭১/২৫ (আশা) নং মামলা দায়ের করেছি।’ পিংকি দুঃখ প্রকাশ কওে জানান, ‘পিতৃহারা একজন অন্তঃসত্ত¡া অসহায় নারী দীর্ঘদিন যাবৎ আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছি। অপরদিকে আমার নরপশু স্বামী, শ^শুর-শাশুড়ি ও তার বন্ধুর নামে ওয়ারেন্ট হলেও তারা গ্রেফতার এড়িয়ে আামাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধামকি ও মামলা তুলে নিতে বিভিন্ন ধরনের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এরমধ্যে গর্ভবতী অবস্থায় আমাকে তালাক দিয়েছে মর্মে গুজব রটিয়েও বেড়াচ্ছে। এজন্য যথাযথ প্রশাসনের কাছে আমার স্বামীর এহেন অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি ও আমার এবং আমার অনাগত সন্তানের জীবনের নিরাপত্তায় অতিদ্রুত আইনি ব্যবস্থা কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।’

ছবির ক্যাপশন: বামে ভুক্তভোগী অন্তঃসত্তা নারী পিংকি খাতুন, মাঝখানে অভিযুক্ত স্বামী হাবিবুর রহমান, ডানে পরোকিয়া প্রেমিকা জান্নাতুল ফেরৌস জান্নাত।