ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


কার ভুলে অস্থির চালের বাজার


৯ জানুয়ারী ২০২১ ০৬:২২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩২

কিছু ভুল সিদ্ধান্তের খেসারতের খড়গ এখন চাল-পেঁয়াজের বাজারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চালের মজুদ কমতে থাকার পরও সরকার মজুদ বাড়ায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ সুযোগে মিলমালিকরা একজোট হয়ে বাজার থেকে ধান কিনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন বলেও তথ্য মিলেছে। এখন তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন।

বাজারে মোটা চালের খুচরা দাম কেজিপ্রতি ৫২ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫৮ এবং চিকন চালের কেজি ৬৩-৬৫ টাকা। এক মাস আগেও এসব চালের দাম কেজিতে ৫-৭ টাকা কম ছিল। অন্যদিকে দেশে কী পরিমাণ পেঁয়াজের প্রয়োজন হবে তার হিসাব না করেই চাহিবামাত্র আমদানির অনুমোদন (আইপি) দেওয়া হয়েছে। এখন বাজারে চাহিদার চেয়ে পেঁয়াজের সরবরাহ অনেক বেশি। এতে পেঁয়াজের দাম কমছেই। এর মধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা চাইছেন পেঁয়াজের আরও কিছু আইপি দিতে।

যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সরকারি আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। বাজার অর্থনীতির মৌলিক সূত্র হলো, পণ্যের জোগান কমলে দাম বাড়বে, জোগান বাড়লে দাম কমবে। আবার গিফেন দ্রব্য অর্থাৎ যেসব পণ্যে দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য সেসবের জোগান কমলে দাম ও চাহিদা দুটোই বাড়বে। বাজারে তখন মূল্যস্ফীতি ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়। গড়ে উঠে অসাধু সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। চাইলে সরকার বাজারে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের সরকার বিপণন সংস্থা গড়ে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি সরবরাহ হওয়া পণ্য কিনে নেয়। সরবরাহ কমে গেলে বাজারে সরবরাহ বাড়াবে। এবার চাল ও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সরকার এ নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বাজারে যখন অতিরিক্ত চাল ছিল সরকার তখন চাল কিনতে ব্যর্থ হয়। এখন সরকারের মজুদ তলানিতে ঠেকেছে। মিলমালিকরাও সুযোগ বুঝে জোট বেঁধে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কারসাজিতে সুবিধার জন্য সরকারকেও কেউ চাল দিচ্ছেন না। বিশ্ববাজারেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাই বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চালের দাম। সরকার শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আর পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমদানির অনুমতি চাওয়ামাত্র অনুমোদন দিয়েছে। এখন বাজারে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ অনেক বেশি। সরকার না মানলেও পেঁয়াজের বাজার ঠিকই অর্থনীতির সূত্র মেনে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। পণ্ড হচ্ছে খেটে খাওয়া কৃষকের ঘাম-রক্ত ঝরানো শ্রম। আমদানির অনুমোদন পাওয়া সব পেঁয়াজ বাজারে এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক এ কে এম মুনিরুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে চালের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। কৃষকরাও ভালো দাম পাচ্ছেন। বাজারে সংকট কোথায় সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। সরকারকে এখনই মজুদ বাড়াতে হবে। আমদানি করে হলেও সেটা সরকারকে করতে হবে। তবে আমি বেসরকারিভাবে আমদানির অনুমোদন দেওয়ার পক্ষে না। এতে আগামী মৌসুমে দামে বড় ধস নামবে। আর পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে কৃষককে দাম দিতে হবে। এবার যদি কৃষক পেঁয়াজে দাম না পান তাহলে আগামী বছর তারা কেন চাষ করবেন? আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছি, আমাদের এই অর্থবছরে কোনোভাবেই আর পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া চলবে না।’

সরকারের মজুদের চিত্র : খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি আমন মৌসুমে সরকার সাড়ে আট লাখ টন আমন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে রয়েছে দুই লাখ টন ধান, ছয় লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল। গত ৭ নভেম্বর থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ হাজার ৩৮৭ টন সিদ্ধ চাল, ৮৪০ টন আতপ চাল এবং ১ হাজার ৪ টন আমন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে। সবমিলে চালের আকারে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫ হাজার ৮৯৫ টন। গত ২৩ ডিসেম্বর এর পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২২৯ টন। এর আগে গত বোরো মৌসুমে সরকার আট লাখ টন ধান কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু কিনতে পেরেছে মাত্র ২ দশমিক ২ লাখ টন।

বোরো ও আমন মৌসুমে সরকার ধান-চাল কিনতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের চালের মজুদ ক্রমেই কমছে। খাদ্য অধিদপ্তরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের মজুদ ছিল ৫ লাখ ৪২ হাজার টন। গত ৬ জানুয়ারিতে তা কমে ৫ লাখ ৩২ হাজার টনে দাঁড়ায়। এ সময়ের মধ্যে আমদানি করা দেড় লাখ টন চাল না এলে মজুদ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাইয়ে সরকারের খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ১৪ হাজার টন। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৩৩ হাজার টনে। সেপ্টেম্বরে ১৩ লাখ ৯২ হাজার টন, অক্টোবরে ১০ লাখ ৮১ হাজার টন এবং নভেম্বরে সরকারের গুদামে মজুদ ছিল ৮ লাখ ৮০ হাজার টন। মজুদ করা খাদ্যশস্যের ৭৫ শতাংশই চাল।

ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৬ হাজার ৭০০ টন। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার ১০০ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৩ লাখ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৬ হাজার ৩৪০ টন চাল উৎপাদন হয়। চলতি আউশ মৌসুমে ৩৫ লাখ টন আউশ উৎপাদিত হয়। এছাড়া ১ কোটি ৫৬ লাখ টন আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরও অধিদপ্তরের আশা এবার দেড় কোটি টনের বেশি আমন উৎপাদিত হবে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ কোটি ৪১ লাখ টন।

কয়েক দিন আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চালকলগুলো আমাদের চাল দেয়নি। আমরা এখন আমদানি করছি। দেড় লাখ টন আমদানি হয়েছে। আরও চার লাখ টনের দরপত্র সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজনে আরও আমদানি হবে।’

অতিরিক্ত আমদানির অনুমোদনে পেঁয়াজের দামে ধস : দেশে পেঁয়াজের সঠিক চাহিদা কত তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, বছরে ৩২-৩৪ লাখ টন পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়। ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু উত্তোলন-পরবর্তী সংরক্ষণজনিত ক্ষতি শতকরা ২৪ ভাগ বাদ দিলে প্রকৃত উৎপাদন দাঁড়ায় ১৯ লাখ টন। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯ লাখ ৪৬ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় চার লাখ টন বেশি।

গত সপ্তাহে পেঁয়াজের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ডিএই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে মোট ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৪৬ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন (আইপি) দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ২৯৩ টন। জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ছয় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা হবে। এছাড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছয়-সাত লাখ টন দেশি নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। উৎপাদনের মাধ্যমে ২৭ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪০ টন পেঁয়াজ পাওয়া যাবে। সবমিলে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার ৯২১ টন পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ হবে। এছাড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে আরও এক লাখ টন পেঁয়াজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৩৩ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এই সাড়ে ৩৮ লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে এলে দামে আরও ধস নামবে।

ডিএইর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনের কেজিপ্রতি গড় খরচ ২২ টাকা। বর্তমানে কৃষকরা কেজিপ্রতি পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারছেন ২৪-২৫ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে এখন পেঁয়াজের কেজি ২৭-২৮ টাকা এবং খুচরায় তা ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জানুয়ারির মধ্যে বেশিরভাগ আইপির মেয়াদ শেষ হতে চলায় সবাই আগেভাগে ঋণপত্র (এলসি) খুলে রাখছেন। যদি এই ছয় লাখ পেঁয়াজের পুরোটা বাজারে প্রবেশ করে তখন বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।