যারা আওয়ামী লীগকে প্রধান শত্রু টার্গেট করে রাজনীতি করেছে, তারাই এখন ক্ষমতাসীন দলে সুবিধাজনক পদ-পদবি পেয়েছেন
জামায়াত-শিবির-ফ্রিডম পার্টি থেকে ঠাঁই মিলেছে আওয়ামী লীগে
অবৈধ ক্যাসিনো, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ নানা ক্ষেত্রে সরকারের শুদ্ধি অভিযানের ফলে একে একে বেরিয়ে আসছে লেবাস পাল্টানো একশ্রেণির নেতার ভয়াবহ অপকর্মের নানা তথ্য-প্রমাণ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকা এসব ‘মুখোশধারী’ প্রভাবশালী নেতার কুকীর্তি ধীরে ধীরে উন্মোচন হচ্ছে। এক সময় যারা আওয়ামী লীগকে প্রধান শত্রু টার্গেট করে রাজনীতি করেছে, তারাই এখন ক্ষমতাসীন দলে সুবিধাজনক পদ-পদবি পেয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের এসব পদ-পদবি ব্যবহার করে এলাকাভিত্তিক প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন এসব ‘হাইব্রিড’ নেতা। স্থানীয় এমন বেশকিছু নেতার মধ্যে রাজধানীর মুগদা থানার ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া খান রাজা ও লালবাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি দিল মোহাম্মদের নাম অন্যতম। এরকম আরও কয়েকজনের বিষয়েও জানা গেছে নানা অপকর্মের তথ্য।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, মুগদার গোলাম কিবরিয়া খান রাজা শিবির থেকে ফ্রিডম পার্টি হয়ে মাত্র পাঁচ বছর আগে আওয়ামী লীগে জায়গা করে বাগিয়ে নিয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো পদ। এছাড়া লালবাগ থানার সাবেক ৫৯ নং (বর্তমান ২৩) ওয়ার্ড বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক থেকে বর্তমানে লালবাগ-চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতির পদে আসীন হয়েছেন দিল মোহাম্মদ। এরকম আরও অনেকেই পুরো উল্টো আদর্শের রাজনৈতিক দল করেও বর্তমানে ক্ষমতা ও টাকা কামানোর জন্য আওয়ামী লীগের জায়গা করে নিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে মূলত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় ও মধ্যম পর্যায়ের একশ্রেণির নেতা দায়ী বলে মনে করেন অনেকেই। কারণ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েই অন্য দলের সুবিধাবাদী ওই নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদ কিনেছেন। অন্য দলের ‘মুখোশধারী’ এসব নেতাই আওয়ামী লীগের ব্যানারে সবচেয়ে বেশি অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর মুগদা থানার ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া খান রাজা ১৯৮৩ সালের ৩ আগস্ট তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক শেরাটন) হোটেলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক, রশীদ ও ডালিমদের হাত ধরে ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন। ওই সময় কর্নেল ফারুকই তাকে ফ্রিডম রাজা বলে নাম দিয়েছিল। তার আগে এই ফ্রিডম রাজা ছিলেন শিবিরের সক্রিয় নেতা বা সদস্য। ২০১৪ সালে মুগদার ৭নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য বিএম সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে স্থান করে নেন ফ্রিডম রাজা। কেবল দলে ঠাঁই নয়, বাগিয়ে নেন ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও। আওয়ামী লীগে ঠাঁই ও দলীয় পদ পেতে গোলাম কিবরিয়া রাজা কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছেন বলেও জানা গেছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোলাম কিবরিয়া খান রাজা মুগদা আওয়ামী লীগের ৬নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পরপরই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আশপাশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। ওই হাসপাতালের টেন্ডার ও মালামাল সরবরাহ থেকে শুরু করে সবকিছুই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন রাজা। এমনকি হাসপাতালকেন্দ্রিক ওই এলাকার দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজিও নিয়ন্ত্রণ হয় তারই মাধ্যমে। শিবির বা ফ্রিডম পার্টি থেকে মাত্র পাঁচ বছর আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন মুগদার ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীকে অন্ধকারে রেখে তারই আশপাশের লোকজন রাজাকে দলে ভেড়ানো ও পদ প্রদানের কাজটি করেছেন। অথচ এই রাজাসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন মুগদা কমিউনিটি সেন্টারে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরীর ওপর হামলা চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুগদার ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া খান রাজা সময়ের আলোকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ বলা হচ্ছে তার কোনোটিই সঠিক নয়। তিনি আগামীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করবেন বলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। শিবির বা ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি ডাহা মিথ্যা কথা দাবি করে রাজা বলেন, আমি ১৯৮৬ সালে ঢাকায় বসবাস শুরু করি। এর আগে বাবার চাকরির সুবাদে শ্রীমঙ্গলে ছিলাম। ১৯৯৬ সালে সাবের হোসেন চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতি শুরু করি।
মুগদা হাসপাতালসহ আশপাশের প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাও সঠিক নয়। তবে এটা সত্য যে, আমরা চেষ্টা করি হাসপাতালের কাজগুলো যেন আমাদের স্থানীয় কর্মীরা পান। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বলে ব্যবস্থা করি। এছাড়া গত ডেঙ্গু মৌসুমে হাসপাতালে অনেক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছিলাম, তাই অনেকে হাসপাতালের সঙ্গে আমাকে নানাভাবে জড়িয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে মুগদার ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ওলী উল্লাহ জুম্মন বলেন, গোলাম কিবরিয়া খান রাজা আগে যাই করুন না কেন এখন তিনি এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি, এটাই বড় কথা। তিনি আমার সহকর্মী, এর বাইরে আমি কোনো মন্তব্য করব না।
অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২০ আগস্ট লালবাগের তৎকালীন ৫৯ নং ওয়ার্ড বিএনপির ১০৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে সহসাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন দিল মোহাম্মদ। এরপর বিএনপির বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এবং প্রতিবাদ কর্মসূচিতে প্রথমভাগেই ছিলেন দিল মোহাম্মদ। ধীরে ধীরে বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়লে দিল মোহাম্মদ লেবাস পাল্টে যোগ দেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগে। সেখানে ওয়ার্ড নয় লালবাগ ও চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতির মতো পদও পেয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওসারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে এই পদ পান দিল মোহাম্মদ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পুরান ঢাকার লালবাগ ও চকবাজার এলাকায় দিল মোহাম্মদ এখন বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি এবং মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও করে থাকেন দিল মোহাম্মদ। এমনকি তিনি তার নানা অপকর্ম নির্বিঘ্নে করতে এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য গড়ে তুলেছেন কিশোর ও তরুণদের নিয়ে একাধিক গ্যাং। এছাড়া দিল মোহাম্মদের লোকজন স্থানীয় ইরাকি মাঠ, নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন দোকান ও বিডিআর ৩নং গেট এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত গাড়ি থেকে মিয়মিত চাঁদা আদায় করেন বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার লেবাস পরায় স্থানীয়রাও ভয়ে প্রতিবাদ করেন না। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মহানগরের অনেক নেতার সঙ্গে পাশাপাশি ছবি তুলে সেটি এলাকায় প্রচার করে প্রভাব সৃষ্টি করে থাকেন এই দিল মোহাম্মদ।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে দিল মোহাম্মদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ও এলাকায় গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।