সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন সুমিসহ নির্যাতনের শিকার ৯২ নারী
‘তোকে কিনেছি, যা ইচ্ছা তাই করব’

‘প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতে তারা থেমে যেত না। ওই অবস্থায়ই শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা।
আমি প্রথমে যেই বাসায় ছিলাম, সেই বাসার মালিক চালাত এমন নির্যাতন। একপর্যায়ে ওই মালিক আমাকে বিক্রি করে দেয় আরেক বাসায়। ওই বাসায় গিয়ে পড়ি আরেক বিপদে। সেখানেও শারীরিক নির্যাতন। নতুন মালিক বলল, বাংলাদেশি প্রায় ৪ লাখ টাকায় আমাকে কিনেছে সে। আত্মরক্ষায় প্রতিবাদ করলে নতুন মালিক বলে, “তোকে কিনে এনেছি। তোর সঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই করব।” এভাবে প্রতি রাতে আমার ওপর চলত নির্যাতন।’
গতকাল শুক্রবার দেশে ফিরে এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন সৌদিতে যাওয়া নারী শ্রমিক সুমি আক্তার। তার বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতী গ্রামে। গতকাল সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। তার সঙ্গে দেশে ফিরেছেন নির্যাতনের শিকার আরও ৯১ নারী গৃহকর্মী। এ সময় ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের পরিচালক ও উপসচিব মো. জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নে সহযোগিতা করেন।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সুমিকে ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে বের করে নিয়ে আসা হয়। এরপর বোর্ডের নিজস্ব গাড়িতে সুমিকে তার বাড়ি পঞ্চগড়ের উদ্দেশে পাঠানো হয়। স্বামী নুরুল ইসলাম বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকলেও তার কাছে সুমিকে হস্তান্তর করা হয়নি।
সুমিকে বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর : সুমি আক্তারকে গতকাল বিকেলে পঞ্চগড়ের বোদায় তার বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান সুমিকে তার বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মলিকা বেগমের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় সুমির স্বজন ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সুমির পরিবারের সদস্যরা জানান, চলতি বছর ৩০ মে রিক্রুটিং এজেন্সি ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের’ মাধ্যমে সৌদি আরব যান ঢাকার আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার নুরুল ইসলামের স্ত্রী সুমি। সেখানে যাওয়ার পর নিয়োগকর্তাসহ (কফিল) অন্যদের নির্যাতনের মুখে পড়েন তিনি। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এ মাসের শুরুর দিকে একপর্যায়ে ফেইসবুকে আপলোড করা এক ভিডিও বার্তায় কান্নায় ভেঙে পড়ে দেশে ফেরার আকুতি জানান। ওই ভিডিওতে সুমি বলেন, ‘ওরা আমারে মাইরা ফালাইবো, আমারে দেশে ফিরাইয়া নিয়া যান। আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়া যান। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যাবো। ভালো কাজের কথা বলে এনে এখন আমার ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।’
এরপর সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের হস্তক্ষেপে গত ৪ নভেম্বর সুমিকে নিয়োগকর্তার বাড়ি থেকে নিয়ে আসে দেশটির পুলিশ। তাকে রাখা হয় সেফহোমে। কিন্তু পরদিন ৫ নভেম্বর পাওনা ২২ হাজার রিয়াল হাতে পাওয়ার আগে তাকে ‘ফাইনাল এক্সিট’ দেবেন না বলে তখন জানিয়েছিলেন তার কফিল। পরে দেশটির নাজরান শহরের শ্রম আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তির পর সুমির দেশে আসার পথ তৈরি হয়। ১০ নভেম্বর আদালত সুমির কফিলের (নিয়োগকর্তা) দাবি করা ২২ হাজার সৌদি রিয়াল পরিশোধের আবেদন নামঞ্জুর করে এবং তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়।
সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্নে সুমির বিদেশযাত্রা : সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় দিনমজুর। চার ভাইবোনের মধ্যে সুমি বড়। দুই বছর আগে আশুলিয়ার চারাবাগের নুরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় সুমির। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, আগেও একটি বিয়ে করেছেন তার স্বামী। বিয়ের দেড় বছর পর তার একটি সন্তানও হয়। কিন্তু সতীনের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এবং একমাত্র সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমি। যার ধারাবাহিকতায় চলতি বছর জানুয়ারিতে গৃহকর্মীর প্রশিক্ষণ শেষ করেন সুমি। পরে তাকে বিনাখরচে সৌদিতে পাঠানোর প্রলোভন দেখায় দালালরা। শেষমেশ দালালদের খপ্পরে পড়ে গত মে মাসে সৌদিতে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর কথা বলে দালালচক্র যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে সে কথা জানতেন না সুমি। সৌদি যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই তার ওপর শুরু হয় মারধর ও যৌন হয়রানিসহ নানা নির্যাতন।
এদিকে মেয়ের ওপর নির্যাতনের কথা জানতে পেরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছেন মা মলিকা বেগম। মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে এনে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অভাব-অনটনের সংসারে কিছু টাকা আয়ের জন্য বিদেশে গিয়েছিল মেয়েটা। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন অবস্থার শিকার হবে আমার এই মেয়েটি।’
সুমির স্বামী নুরুল ইসলাম জানান, স্ত্রীর ওপর নির্যাতনের খবর জানতে পেরে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তিনি বাদী হয়ে সুমিকে সৌদিতে পাঠানো রিক্রুটিং প্রতিষ্ঠান ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজের’ মালিক আক্তার হোসেনের নামে পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।