মোবাইল নেটওয়ার্কের মান বাড়াতে টাওয়ার শেয়ারে গুরুত্বারোপ
মোবাইল নেটওয়ার্কের মান উন্নয়নে টাওয়ার স্বল্পতা নিরসনে টারওয়ার কো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তঃ শেয়ারিং, টাওয়ারে সোলার প্যানেল, সীমান্তে নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে ক্রসবর্ডার পররাষ্ট্র নীতি জোরদার ও নাগরিক পর্যায়ে তরঙ্গ তেজস্ক্রীয়তা ভীতি দূর করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে অনুষ্ঠিত ‘মোবাইল নেটওয়ার্কের মানোন্নয়নে টাওয়ার স্বল্পতা নিরসণে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব দাবি উত্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় দেশের মোবাইল অপারেটর, টাওয়ার স্থাপন প্রতিষ্ঠান এবং টাওয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বক্তব্য রাখেন বিইআরসি’র সাবেক সদস্য মকবুল ই এলাহী, প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালেদ আবু নাসের, টেলিটক বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার এস এম মাসুম, কীর্তনখোলা টাওয়ার্স লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার এহতেশাম খান, ফ্রন্টিয়ার লিমিটেডের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স মো. তাজনীন আলম, টাওয়ার নির্মাণ কাজে ঠিকাদারদের পক্ষে আব্দুল বাতেন খান, সামিট টাওয়ার্স লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স আদনান শাহরিয়ার, গ্রামীণ ফোনের সিনিয়র ডিরেক্টর ও করপোরেটর অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত, রবি আজিয়াটার চিফ রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ব্যারিস্টার সাহেদুল আলম, বাংলালিংক লিমিটেডের চিফ রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স তৈমুর আলম ও সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ডি. এম. মুজিবুর রহমান।
সভায় উপস্থাপিত তথ্যচিত্রে ইডটকো হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের অ্যাসোসিয়েটস ডিরেক্টর মাসুদা হোসাইন বলেন, প্রতি মাসে একজন গ্রাহক ছয় জিবি ডেটা ব্যবহার করে। আগামী চার বছর পর এটি ১৭ জিবিতে পৌঁছবে। এই চাহিদা পূরণে ৪৪ হাজার টাওয়ার রয়েছে। সম্ভাব্য চাহিদা মেটাতে আরো ১২ হাজার টাওয়ার লাগবে। টাওয়ার বাড়ানোর জন্য টাওয়ারগুলোকে বহুমুখী ব্যবহারের স্মার্ট হাইটেক নীতিমালা এবং বহুপক্ষীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতিজনিত বাধা দূর করা দরকার।
এসময় ইক্যুইপমেন্ট আমদানি সহজতর হওয়া ও ৫ বছরের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ও এনওসি সহজিকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
আলোচনায় সোলার ইলেকট্রো কোম্পানি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বি এম মজিবুর রহমান টাওয়ারে সোলার প্যানেল বসানোর জন্য ভার্টিক্যাল মডেল ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সোলার প্যানেল স্থাপনে লিথিয়াম ফসফেট ও লিথিয়াম আয়ন ব্যবহার করলে দীর্ঘ সময় সাপোর্ট দেবে।
টাওয়ার নির্মাণ কাজে ঠিকাদারদের পক্ষে আব্দুল বাতেন খান অভিযোগ করে বলেন, আমরা ২০০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু ১৫০ কোটি টাকা আটকে আছে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি’র মাধ্যমে। ২১ দিনের মধ্যে টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ৬ মাসেও আমাদের বিনিয়োগ ফেরত দিচ্ছে না টাওয়ারকো কোম্পানিগুলো। জিপি ও ফ্রন্টিয়ার আমাদের টাকা আটকে রেখেছে। এ নিয়ে বিটিআরসিতে নালিশ করে কোনো লাভ পাচ্ছি না। আমরাও হার্ড লাইনে গেলে আমাদের দোষ দিবেন না।
প্রতি উত্তরে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে হোসেন সাদাত বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা করার কোনো সুযোগ নেই। ফ্রন্টিয়ারের দায় আইনগতভাবে আমরা নিতে পারিনা। কাজ দিলে চুক্তির ৬০ শতাংশের বেশী তারা পূরণ করতে পারে না। ক্ষমা চায়। কিন্তু আমরাও তো বিনিয়োগকারীদের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু কোনো কাজই আমরা ঝটপট করতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, বিটিআরসি নিয়ম বেধে দেয় একটি টাওয়ার কোম্পানির সাথে ৩০ শতাংশের বেশী রোলআউট করা যাবে না।
টাওয়ার ভেন্ডরদের জন্য আইনগত কোনো সমাধান নেই। ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় টাওয়ার স্থাপন করতে চাইলেও সেটা তৈরি করা যায় না- যোগ করেন হোসেন সাদাত।
প্যারালাল টাওয়ার ও টাওয়ার শেয়ারে অনীহার বিষয়ে অভিযোগ করে এই খাত ম্যাচিউর হওয়ার আগেই প্রতিযোগিতায় জুড়ে দেয়ায় মহৎ উদ্দেশ্যগুলো ভেস্তে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ব্যারিষ্টার শাহেদ আলম। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া হয়েছে।
ব্যান্ডউইথ পড়ে থাকার বিষয়টি বায়বীয় একটি বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ব্যান্ডউইথ কেনার সময় ২৪ ঘণ্টার হিসাব ধরে পিক আওয়ার হিসেবে ব্যান্ডউইথ ধার্য করতে হয়। তাই বিদ্যুতের মতো ব্যান্ডউইথও ধরে রাখা যায় না। আর অব্যবহৃত তরঙ্গ ব্যবহারে নতুন প্রযুক্তি লাগবে। এ মুহূর্তে রোল আউট করা সম্ভব নয়।
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তরঙ্গ তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গণমানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারণা ও ভুল কন্টেন্ট কমাতে হবে। একইসঙ্গে টাওয়ার শেয়ার করার প্রবণতা বাড়াতে হবে। সরকারের উদাসীনতা কাটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিটিআরসি’র সংস্কার করবে বলে আশা করি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে সক্রিয় সিমের সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার। ট্রাফিক তথা টেলি ডেনসিটি অনুযায়ী প্রতি বর্গ কিলোমিটার জোরে অন্ততপক্ষে একটি অপারেটরে একটি টাওয়ার থাকার কথা। সে অনুযায়ী দেশের চারটি অপারেটরের টাওয়ারের পরিমাণ হওয়ার কথা প্রায় ২ লাখ। কিন্তু টাওয়ার শেয়ারিং ও নেটওয়ার্ক শেয়ারিং এর কারণে টাওয়ারের প্রয়োজন বর্তমানে ন্যূনতম পক্ষে এক লাখ। কিন্তু জুলাইয়ের বিটিআরসি সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের মোট টাওয়ার সংখ্যা রয়েছে ৪৫ হাজার ৫৭৪টি। অর্থাৎ মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ টাওয়ার রয়েছে।
তিনি বলেন, টাওয়ারকো প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের সহযোগী ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে না পারলে আগামীতে নেটওয়ার্ক তৈরিতে শুধু নয় নেটওয়ার্কে একটি বিপর্যয় আসতে পারে। আমাদের দেশে অপ্রতুল জমি, এবং মানুষের মধ্যে রেডিয়েশন নিয়ে ভুল ধারণা থাকার কারণে বিগত সরকার ২০১৮ সালে চারটি কোম্পানিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার অবকাঠামো ভাগাভাগি সংক্রান্ত টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্স দিয়েছে।
টাওয়ারের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর টাওয়ার সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বর্তমানে জিপির টাওয়ারের সংখ্যা ১২ হাজার ৫২৬টি, রবির ২ হাজার ২৭৬টি, বাংলালিংকের ৪ হাজার ৬টি, টেলিটকের ৩ হাজার ৩২০টি, ইডটকো লিমিটেডের ১৬ হাজার ৭৩২, সামিটের ৪ হাজার ৫৪৯টি, কীর্তনখোলার ৭৩৫টি, ফ্রন্টিয়ারের ১১৬টি, এবং বিটিসিএলের টাওয়ার রয়েছে ৫১৪ টি।
সীমান্ত এলাকায় নেটওয়ার্ক বর্ডার ক্রস আইনানুযায়ী বাংলাদেশের অপারেটররা টাওয়ার তৈরি করতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ঠিকই টাওয়ার নির্মাণ করছে।
এ ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করে সমস্যা নিরসনে কাজ করতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য ও পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি. এর ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির), বিডিজবস এর ফাউন্ডার ফাহিম মাশরুর, ফ্রন্টিয়ার কনট্রাক্টরর্স ফোরামের প্রতিনিধিরাসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ।