মানব জীবনের ৪০ বছর : পরিপক্বতা কি এখানেই?

৪০তম বছর মানুষের জীবনের অন্যতম মাইলফলক। সাধারণত এই বয়সে মানুষের মধ্যে পূর্ণ পরিপক্বতা আসে। এই বয়সী মানুষদের মধ্যে তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার শক্তি বেশি থাকে। এ বয়সে মানুষ পূর্ণ জ্ঞান, বোধশক্তির অধিকারী হয়।
পবিত্র কোরআনে এই বয়সের পরিপক্বতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতিকষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ৩০ মাস।
অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং ৪০ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, ‘হে আমার রব, আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার ওপর ও আমার মাতা-পিতার ওপর যে নিয়ামত দান করেছ, তোমার সে নিয়ামতের যেন আমি শোকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয়ই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ১৫)
অতএব, ৪০-এ পা দিলে মুমিনের উচিত নিজের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের ব্যাপারে আরো সতর্ক হয়ে যাওয়া।
মাসরুক (রহ.) বলেন, যখন তোমার বয়স ৪০, তখন সতর্ক হয়ে যাও।
এ বয়সে পা রাখার পর আর অবহেলায় সময় কাটানোর সুযোগ নেই। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ ও জন্মদাতা মা-বাবার হকের ব্যাপারে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। এ বয়সে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যেমন সতর্ক হওয়া উচিত, তেমনি পরকালের প্রস্তুতি ও দুনিয়ার জীবনে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলোর ব্যাপারেও যত্নবান হওয়া উচিত।
কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি ৪০ বছরে পৌঁছেছে, তার জন্য সময় এসেছে তার ওপর এবং তার মা-বাবার ওপর আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মূল্য উপলব্ধি করার এবং সেগুলোর শোকর আদায় করার।
ইমাম মালিক (রহ.) বলেছেন, ‘আমি আমাদের দেশে জ্ঞানীদের এমন অবস্থায় দেখেছি যে তাঁরা দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতেন এবং মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, যতক্ষণ না তাঁদের কারো বয়স ৪০-এ পৌঁছাত। কিন্তু যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয়ে যেত, তখন তাঁরা মানুষ থেকে দূরে সরে যেতেন (অর্থাৎ একান্তভাবে ইবাদত ও আখিরাতের প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করতেন)।’ (তাফসির কুরতুবি : ৭/২৭৬)
হয়তো এই পরিপক্বতার কারণেই মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে এই বয়সে নবুয়তের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। হাদিসের বর্ণনা মতে, আমাদের প্রিয় নবী (সা.) যখন নবুয়ত লাভ করেন, তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) খুব দীর্ঘ ছিলেন না, আবার খাটোও ছিলেন না। তিনি ধবধবে সাদা কিংবা বাদামি বর্ণেরও ছিলেন না। তাঁর চুল একেবারে কোঁকড়ানো ছিল না, আবার একেবারে সোজাও ছিল না। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুয়ত দান করেন। এরপর মক্কায় ১০ বছর এবং মদিনায় ১০ বছর কাটান। আল্লাহ তাআলা ৬০ বছর বয়সে তাঁকে ওফাত দান করেন। ওফাতকালে তাঁর মাথা ও দাড়ির ২০টি চুলও সাদা ছিল না। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ১)
এমনকি মুসা (আ.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির বয়সও যে ৪০-এর কাছাকাছি তার ইঙ্গিত পবিত্র কোরআনে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মুসা যখন যৌবনে পদার্পণ করল এবং পরিণত বয়স্ক হলো, তখন আমি তাকে বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করলাম। আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ১৪)
তাফসিরবিদদের মতে, পরিণত বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত থাকে। (ফাতহুল কাদির)
বিজ্ঞানের মতেও মানুষের ৪০ বছর বয়সের তাৎপর্য রয়েছে। Psychological Science জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, মানুষের fluid intelligence বা তাত্ক্ষণিক সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা জীবনের বিভিন্ন বয়সে শিখরে পৌঁছে এবং কিছু ক্ষমতা প্রায় ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে।