ঢাকা রবিবার, ২৪শে আগস্ট ২০২৫, ১০ই ভাদ্র ১৪৩২


ইসলামে ‘হানি ট্র্যাপ’ একটি ঘৃণ্য অপরাধ


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৫৫

সত্য-মিথ্যার আড়ালে দুর্নীতি এবং অপরাধ সংঘটনে ভালোবাসার ফাঁদ পাতা বা যৌনতা-কেন্দ্রিক কৌশলের ব্যবহারই 'হানি ট্র্যাপ'। সুরা বাকারার ৪২ নম্বর আয়াতের নির্দেশনা, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ো না এবং জেনেবুঝে সত্য গোপন কোরো না।’

হানি ট্র্যাপ, অর্থাৎ ভালোবাসার ফাঁদ, যেখানে যৌনতা বা রোমান্টিক প্রলোভন দেখিয়ে কারো কাছ থেকে তথ্য বের করা, তাদের বশ মানানো বা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করা হয়। হানি ট্র্যাপের মাধ্যমে সাধারণত একজন নারী বা পুরুষ টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে তার কাছ থেকে গোপন তথ্য ও আর্থিক ফায়দা লুটে নেয়।

প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা, অর্থ আদায়, কারসাজি, গুপ্তচরবৃত্তি ও অন্য অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হয় হানি ট্র্যাপ।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। এমন অপকৌশলে মুমিন বান্দা সাড়া দেবে না। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা, ‘বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি... আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ঠ থেকে, যে মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়—মানুষের অন্তরে, জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকেও।’ (সুরা : নাস, আয়াত : ০১- ০৬)

সামান্য ভুলে মারাত্মক ক্ষতি—এমনকি সারা জীবনের সব সাধনা ও সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। শয়তানের অপকৌশল, মোহনীয় প্রলোভন, বিতর্ক, বিভেদ ও অনাচার থেকে সতর্ক থাকা মুমিন বান্দার সব সময়ের কর্তব্য—‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ কোরো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে...।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২১)

হানি ট্র্যাপ এবং সুরা নুরের ০৩ নম্বর আয়াতের পটভূমি প্রাসঙ্গিক। উম্মে মাহজুল, অপর বর্ণনা মতে ‘আনাক’ নাম্নী এক ভ্রষ্ট নারী সরলমনা এক সাহাবিকে প্রলুব্ধ করে, এমনকি বিয়ের প্রস্তাব দেয়! (তিরমিজি)

তখন পবিত্র বাণী অবতীর্ণ হলো, ‘ব্যভিচারী পুরুষ-ব্যভিচারিণীকে অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া বিয়ে করে না এবং ব্যভিচারিণী নারী, তাকে ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ছাড়া কেউ বিয়ে করে না, আর মুমিনদের জন্য এটা হারাম।’

হানি ট্র্যাপ প্রতারণামূলক একটি জঘন্য অপরাধ। ‘রিজিকদাতা’ মহান আল্লাহ মানুষের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘রিজ্কান কারিমা’ (সম্মানজনক জীবিকা) এবং এর অর্জন কৌশল হতে হবে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ (বৈধ ও পবিত্র)। অন্যদিকে হারাম উপার্জন বর্জনীয়। মহান আল্লাহর নির্দেশ, ‘তোমরা বৈধ ও পবিত্র বস্তু গ্রহণ করো আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৬৮)

তিনি আরো বলেন, ‘বিনাস ও বিপর্যয় ধোঁকাবাজদের জন্য...।’ (সুরা : মুতাফিফফিন, আয়াত : ০১)

হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) সাহাবাদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে নিঃস্ব গরিব?’ সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহ! যার কোনো টাকা-পয়সা নেই।’

রাসুল (সা.) বলেন, ‘না। প্রকৃত গরিব ওই ব্যক্তি, যে কিয়ামতে পাহাড়সম নেকি নিয়ে উঠবে; অথচ সে জাহান্নামে যাবে। কারণ সে দুনিয়ায় কাউকে গালি দিয়েছিল, প্রতারণা করেছিল, অন্যের হক নষ্ট করেছিল...সে পাওনাদারদের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যাবে।’ (মুসলিম)

তাঁরই (সা.) বাণী—‘প্রতারক আমার দলভুক্ত নয়।’

মুসলিম শরিফের এক দীর্ঘ হাদিসে আছে—‘এক মুসাফির আকাশের দিকে হাত তুলে ডাকছে : হে প্রভু! হে প্রভু...অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম, সে হারামের মধ্যে সব সময় অতিবাহিত করে। তবে তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে?’

বাংলাদেশের আইনে প্রতারণা প্রতিরোধের প্রাসঙ্গিক ধারা : দণ্ডবিধি ৪০৬ ধারা (বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ)। দণ্ডবিধি ৪১৫ ধারায় প্রতারণা (Cheating)-এর সংজ্ঞায় আছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে কোনো সম্পত্তি আদায় করে, তবে সে প্রতারণা করেছে বলে গণ্য হবে। দণ্ডবিধি ৪২০ ধারা (প্রতারণা, প্রতারণামূলকভাবে সম্পত্তি অর্জনের জন্য শাস্তি)।

আমরা জানি সবার আগে লাশের পেট ফোলে। ওই পেটে কী যাচ্ছে, ভাবা দরকার। প্রিয় নবী (সা.)-এর সতর্কবাণীও মনে রাখা জরুরি, ‘মানুষের মাঝে এমন একটা কাল আসবে যখন লোকে কোনো পরোয়া করবে না যে, সে সম্পদ কোথা থেকে লাভ করল—হালাল উপায়ে না হারাম উপায়ে?’ (বুখারি)

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর