ফারইস্টের সাবেক চেয়ারম্যান-পরিচালকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বীমাকারীর বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এমএ খালেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাইকোর্ট।
গতকাল মঙ্গলবার সাবেক সাত পরিচালকের মামলার শুনানি করে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
মামলার বাদী ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে শেয়ারহোল্ডার মো. ফখরুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের পর সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন নজরুল ইসলাম। তিনি যাতে আবার দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য সাবেক পরিচালকরা মামলার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন। অন্যদিকে বর্তমানে এমএ খালেকও দেশে রয়েছেন।
জানা গেছে, ফারইস্টের দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি মামলা করেন কোম্পানির সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে শেয়ারহোল্ডার মো. ফখরুল ইসলাম, হেলাল মিয়া, কামরুল হাসান, শামসুল হক, মুসলিমা শিরিন, নাজনীন হোসেন ও আয়শা হুসনে জামান। এদের মধ্যে ফখরুল ইসলাম ছাড়া অন্যরা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে থাকা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। ফখরুল ইসলাম সর্বশেষ ২০০৮ সালে পরিচালক হিসেবে ছিলেন।
মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, দেশের বীমা খাতে বহুল সমালোচিত ঘটনা ফারইস্ট লাইফের লুটপাট। বোর্ড মিটিংয়ের পর নজরুল ইসলাম ও এমএ খালেক এমনভাবে সারসংক্ষেপ তৈরি করতেন, যার সঙ্গে পর্ষদের সিদ্ধান্তের কোনো মিল থাকত না। এ সারসংক্ষেপ দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা কোম্পানির আমানত বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এ ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় সব দায় এখন শেয়ারহোল্ডারদের নিতে হচ্ছে।
নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যে জমি কেনা, ব্যাংকে রাখা আমানতের বিপরীতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। দেশের বীমা শিল্পে নজিরবিহীন এ লুটপাটে সহায়তা করেছেন বিভিন্ন বোর্ড কমিটি, এমডিসহ পরিচালনা পর্ষদের উল্লেখযোগ্য অংশ। ১০ বছরের বেশি সময় লুটপাট চললেও জালিয়াতির প্রতিবেদন দিয়ে তা আড়াল করেছে একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) এক বিশেষ নিরীক্ষায় ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন নজরুল ইসলাম এবং এমএ খালেক গং। এর মধ্যে নিকটাত্মীয় ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের মাধ্যমে অস্বাভাবিক দরে জমি কিনে ফারইস্ট লাইফের ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি ও প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে বেআইনি বিনিয়োগ করে ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এর বাইরে কর্মচারীদের স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক হিসাব খুলে ভুয়া কমিশন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা কোম্পানির আমানতের বিপরীতে অবৈধ ঋণসুবিধা নিয়ে ৪২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এমএ খালেক। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে অবৈধ বিনিয়োগ এবং ঋণের মাধ্যমে কোম্পানির ৬৫৯ কোটি টাকা পাচার করেছেন নজরুল, এমএ খালেক ও অন্য পরিচালকরা। কোম্পানির কর্মচারীদের নামে দুটি সমবায় সমিতি বানিয়ে আরও ১৯১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। সব মিলিয়ে ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের প্রমাণ মিলেছে। তবে আত্মসাতের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আমানতের ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের শীর্ষস্থানীয় জীবনবীমা কোম্পানিতে পরিণত হয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। একসময়ের দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানটি কতিপয় কর্মকর্তার অবাধ লুটপাটের কারণে এখন বীমাকারীর দাবি মেটাতে পারছে না। বীমা দাবি নিষ্পত্তি না করায় বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) কোম্পানিটির বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে।
কোম্পানিটি ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ১০ বছর ধরে আর্থিক লুটপাট চললেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইডিআরএ। সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন একসময় ফারইস্ট লাইফে উচ্চ পদে ছিলেন। পরবর্তীতে এমএ খালেকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং ফারইস্ট লাইফে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্বতন্ত্র পরিচালক পদে ছিলেন। ফারইস্ট লাইফ ও এর কয়েকজন উদ্যোক্তা-পরিচালকের মাধ্যমে সুবিধাভোগী হওয়ায় কোম্পানিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আমলে নেননি বলে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান মোশাররফের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।