সরকারি বিজ্ঞান কলেজ
ফলাফল ভালো হলেও সংকট অনেক, ৭১ বছরের পুরোনো টিনশেডে চলে ক্লাস

সরকারি বিজ্ঞান কলেজের বেহাল দশা
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ফার্মগেট এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি বিজ্ঞান কলেজ। ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ পাসের হার অর্জন করে আলোচনায় আসে। ১ হাজার ৩০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৮৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওয়ায় বোর্ড র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে। এর আগেও ধারাবাহিকভাবে ২০২২ ও ২০২৩ সালে কলেজটি ছিল দ্বিতীয় স্থানে।
প্রতিষ্ঠানের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য থাকলেও আড়ালে রয়েছে অনেক সংকটের গল্প। অবকাঠামোগ সংকট তীব্র—আজও ক্লাস চলছে টিনশেড ঘরে আর ৭১ বছরের পুরোনো ভবনে। আর রাত হলেই কলেজ চত্বরে বেড়ে যায় স্থানীয়দের উৎপাত। রবিবার (২০ এপ্রিল) সরেজমিনে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে গিয়ে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।
কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সোলায়মান হোসেন রিফাত এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কলেজজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমবর্ষে ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে শিক্ষকদের কড়াকড়ি থাকে, নিয়মিত অ্যাটেনডেন্স নেওয়া হয়। শিক্ষকেরা খোঁজখবরও বেশি নেন। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেই বিষয়টা অনেকটাই বদলে যায়। তখন শিক্ষকদের যত্ন বা তদারকি আগের মতো আর থাকে না। এ বিষয়টা আমাদের মতো পরীক্ষার্থীদের জন্য একটু হতাশাজনক।’
প্রতি ক্লাসে গড়ে ১৩৮ জন শিক্ষার্থী আছেন, যা আদর্শ শিক্ষণ-পরিবেশের জন্য যথাযথ নয়। তাদের মতে, প্রতি ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকলে ভালো হতো। ক্লাসরুম সংকটের কারণে এ চাপ আরও বাড়ছে। কলেজের অবকাঠামো ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি।
তিনি বলেন, ‘সরকারি বিজ্ঞান কলেজের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি বেশ সমৃদ্ধ। আমাদের ডিবেটিং ক্লাব ঢাকার সেরাদের মধ্যে অন্যতম। আমি নিজে স্পোর্টস ক্লাবের সদস্য ছিলাম। কলেজের বাইরেও বিভিন্ন ইন্টার-কলেজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। আমরা সব সময় চেষ্টা করি ভালো ফল নিয়ে আসতে।’
তিনি জানান, এই কলেজের একটি বিশেষত্ব হলো—এখানে শুধু বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররাই ভর্তি হতে পারেন। তার জানামতে, এটি ঢাকার একমাত্র কলেজ, যেখানে শুধু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এখানে ভর্তি হতে হলে অবশ্যই জিপিএ-৫ থাকতে হয়। যদিও আলাদা করে কোনো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় না।
কলেজে প্রথম দিন পা রাখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রিফাত খানিকটা হতাশা প্রকাশ করেন। তার ভাষ্য, ‘যেদিন ভর্তি হওয়ার আগে কলেজে এসেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম আধুনিক কোনো বহুতল ভবন থাকবে, পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস থাকবে। কিন্তু এসে দেখি, বেশিরভাগ ক্লাস টিনশেড ভবনে। এটা সত্যিই কষ্টদায়ক ছিল। ভাবতেই পারিনি, এই পরিবেশে পড়তে হবে। অবকাঠামো অনেক পুরোনো ও নাজুক।’
সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একই শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী ও ২০২৫ সালের পরীক্ষার্থী সৈয়দ মো. জাকারিয়া কলেজ জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন এখানে ভর্তি হলাম, তখন কলেজের গ্রামের মতো শান্ত পরিবেশটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। এখানে আসার পর বুঝলাম, সত্যিই এটা একটা ভালো জায়গা পড়াশোনার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কলেজে একটি ছয়তলা বিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণাধীন, যা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ সংকট কিছুটা লাঘব করবে বলে আশা করা যায়। জাকারিয়ার মতে, ‘আমাদের শিক্ষকরা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। কোনো সমস্যা হলে অনেকে বলেন, তোমরা ছুটির পর এসো, সব বুঝিয়ে দেব। এটা আমাদের জন্য অনেক স্বস্তিদায়ক।’
ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে অনেক কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।’
জাকারিয়া আরও বলেন, ‘আমি গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের কলেজ থেকে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে (বিএমএ) ভর্তি হয়। এখানকার অ্যাকাডেমিক মান খুবই ভালো।’
শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় কলেজে প্রায় ১ হাজার ৬০০ নিয়মিত শিক্ষার্থী থাকতো। এখন সেটা কমিয়ে ১ হাজার ১০০ করা হয়েছে। তবে কলেজে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২ হাজার ২০০ জন।
জাকারিয়ার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের কলেজে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। ঢাকার বাইরে থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী আসে। ফলে তাদের পরিবারও নিশ্চিন্তে আমাদের এখানে পাঠাতে পারে। রাজনীতিমুক্ত পরিবেশে আমরা নির্ভয়ে পড়াশোনা করতে পারি—এটা আমাদের জন্য সত্যিই আশীর্বাদ।’
শিক্ষকরা বলছেন, বর্তমানে প্রতি ক্লাসে গড়ে ১৩৮ জন শিক্ষার্থী আছেন, যা আদর্শ শিক্ষণ-পরিবেশের জন্য যথাযথ নয়। তাদের মতে, প্রতি ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকলে ভালো হতো। ক্লাসরুম সংকটের কারণে এ চাপ আরও বাড়ছে। কলেজের অবকাঠামো ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি।
শিক্ষার্থীদের ২০টি গ্রুপে ভাগ করে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতে হয়। এতে করে লজিস্টিক ও সময় ব্যবস্থাপনায় আলাদা চাপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী দূর-দূরান্ত থেকে এসে আশেপাশের মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। ফলে একাডেমিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কলেজ প্রাঙ্গণে একটি ছোট মাঠ রয়েছে, যা এত শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।
কলেজ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের বোর্ড পরীক্ষায় এ কলেজের পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এখানে প্রায় ১ হাজার ১৮৮ জন শিক্ষার্থী (৪০ শতাংশ) জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। কলেজের মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১ হাজার ৩০০ জন। অবশ্য এর মধ্যে মাত্র চারজন অকৃতকার্য হয়েছে। এ সাফল্যের ফলে ২০২৪ সালে বোর্ড র্যাংকিংয়ে কলেজটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে। এর আগের দুই বছর ২০২২ ও ২০২৩ সালে কলেজটি দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল।
কলেজের সূত্র জানায়, সরকারি বিজ্ঞান কলেজের ভেতরে নিরাপত্তা সংকটও এখন বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কিছু যুবক প্রায় রাতেই কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আড্ডা দেন এবং মাদকসেবন করেন। তারা কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই মাঠে খেলতে আসেন। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও বিনোদনের উপযোগী পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের নিষেধ করলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেন না। মাঝে মাঝে হুমকি আসে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
অবকাঠামোগত দিক থেকেও কলেজটি নানা সমস্যার সম্মুখীন। ১৯৫৪ সালের পুরোনো স্থাপনা এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে নোংরা পরিবেশ, যা শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করছে। বিশেষ করে কলেজের পূর্ব পাশের ভাঙা দেয়াল দিয়ে পার্শ্ববর্তী বাসাবাড়ির নোংরা পানি প্রবেশ করছে ক্যাম্পাসে। এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। সর্বত্র অব্যবস্থাপনার চিত্র স্পষ্ট, যা একটি মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বেমানান বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
ভবিষ্যতে আরও ভালো ফলাফল অর্জনের আশা প্রকাশ করে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কে এম আমিনুল হক বলেন, সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। কলেজের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সীমানা প্রাচীরের সমস্যা, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম, এবং সেকশন ভাগ করে পাঠদান করতে হওয়া। কাঠামোগত দিক থেকেও কলেজটি কিছু সমস্যার সম্মুখীন। অধিকাংশ ক্লাসরুম এখনো টিনের চালা দিয়ে নির্মিত।
এটি ঝড়বৃষ্টিতে ঝুঁকিপূর্ণ এবং যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে উল্লেখ অধ্যক্ষ বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় বর্তমানে একটি ছয়তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। এছাড়া কলেজের দুটি ছাত্রাবাস— কুদরতা খোদা ছাত্রাবাস ও কাজী নজরুল ইসলাম ছাত্রাবাস রয়েছে, যার মধ্যে একটি সংস্কার করে ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকারি বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ চলমান সংকট ও বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, কলেজে জনবল সংকট এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ২০০ জন হলেও শিডিউল অনুযায়ী শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৭ জন। মোট শিক্ষক আছেন ৪৬ জন। কিন্তু কলেজে ন্যূনতম ৫০ জন শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। জনবলের এ ঘাটতি শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পরিবেশে প্রভাব ফেলছে।