'পরীক্ষা শুরুর আগেই আমাদের হাতে উত্তরপত্র চলে এসেছে। সত্য প্রকাশ হবেই। ধামাচাপা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি চাই পুরো ব্যাপারটিই প্রকাশিত হোক।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তার নেতৃত্বে জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ইমদাদুল হক ও সহকারী প্রক্টর মাকসুদুর রহমানের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে একটি প্রতিবেদন উপাচার্যের কাছে জমা দিয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে তদন্ত কমিটির পর্যালোচনা নিয়ে আজ বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তবে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তদন্ত কমিটির এমন প্রতিবেদন সত্ত্বেও কেন ফল ঘোষণা করা হলো? এমন প্রশ্নে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে উপাচার্য মনে করেছেন যে ফল প্রকাশ করতে কোনো সমস্যা নেই, তাই তিনি ফল ঘোষণা করেছেন। আসলে একজন প্রশ্ন ফাঁসকারীর তথ্য পাওয়া গেছে এবং তা দিয়েছেন সাংবাদিকরা। এর পরেই আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। প্রশ্ন ফাঁস আর ডিজিটাল জালিয়াতি যাই বলি না কেন, পরীক্ষা শুরুর আগেই আমাদের হাতে উত্তরপত্র চলে এসেছে। সত্য প্রকাশ হবেই। ধামাচাপা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি চাই পুরো ব্যাপারটিই প্রকাশিত হোক।’
প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান গতকাল প্রশাসনিক ভবনের কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের সামনে তিনি বলেন, ‘এরকম ঘটনা আগেও ঘটত [প্রশ্ন ফাঁস], তখন ব্যবস্থা নেওয়া হত না, এখন হচ্ছে।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে কার্যত প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথাই স্বীকার করে নেন উপাচার্য।
‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত শনিবার এক ভর্তি পরীক্ষার্থী ও তার বাবাসহ মোট ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার তাদের প্রত্যেককে দুই দিনের করে রিমান্ডে পাঠানো হয়।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম কামরুল আহসান ছয় জনের নাম উল্লেখসহ আরও বেশ কয়েকজনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২২ ও ২৩ নম্বর ধারা ও পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে এই মামলা দায়ের করা হয়। এতে বলা হয়, পরীক্ষা শুরুর আগে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ৮১টি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিলেন। পরে কোনো একটি কেন্দ্র থেকে হয়তো কেউ ছবি তুলে তা অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সে কাজটি আমি, আপনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে কারো দ্বারাই হতে পারে। ফলে ওই ৮১টি কেন্দ্রের কোনটি থেকে প্রশ্ন ফাঁস হলো তা বের করা কঠিন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ, 'ঘ' ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলসহ চার দফা দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সোমবার থেকে অনশন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন। ছবি: স্টার
প্রশ্ন ফাঁস হলো, সে পরীক্ষার আবার ফলও ঘোষণা হলো, এক্ষেত্রে মেধাবীদের জায়গায় যারা আগেই প্রশ্নপত্র পেয়েছে তাদের ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে গেল কি না, এমন উদ্বেগের ব্যাপারে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘বিজ্ঞান অনুষদের ‘ক’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার সময়ও আমরা ডিজিটাল জালিয়াতকারী পাঁচ জনকে ডিভাইসসহ ধরেছি এবং পুলিশে দিয়েছি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সহায়তা নিয়ে ঠিক কতজন ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে এক লাখের মতো পরীক্ষার্থীর বৃহত্তর কল্যাণের বিষয়টি চিন্তা করে আপাতত ফল দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যত দ্রুত আমরা প্রশ্ন ফাঁসের মূল সূত্র উদঘাটন করতে পারব, তত দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে, ভর্তি বাতিল করে অপেক্ষমাণ মেধাবীদের সুযোগ দেওয়া যাবে। ব্যাপারটি এখন পুরোটাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের উপর নির্ভর করছে।’
এর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং ডিজিটাল জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘এ সংক্রান্ত অভিযোগে এ পর্যন্ত দুইটি তদন্ত করেছি আমি। একজনের বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকায় তিনি বরখাস্ত হয়েছেন এবং অন্য আরেকজনের পদাবনতি হয়েছে। যেহেতু এবারের তদন্ত কমিটির প্রধানও আমি, সেক্ষেত্রে আমি নির্দয়। সে যেই হোক না কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধান অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারস্থ হবো আমরা।’
এদিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিলসহ চারটি দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। তার এই অনশনের সমর্থনে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আজ তার পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে।
আখতার বলেন, ‘ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটিকে ডিজিটাল জালিয়াতি বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমি প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা চাই। পরীক্ষা শুরু হওয়ার এক মিনিট আগেও যেন কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছাড়া প্রশ্নপত্র কারো হাতে না পড়ে। এছাড়া এ পর্যন্ত জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া সকল শিক্ষার্থীর বহিষ্কার দাবি করছি। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত সব পক্ষকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দিতে হবে।’
এই প্রতিবাদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবগত কি না, এ বিষয়ে আখতার বলেন, গত রাতে প্রক্টরিয়াল বডির মোবাইল টিমের দুই জন আমার সঙ্গে কথা বলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবাদ লিপি জমা দেওয়ার চিন্তা করছেন বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, তার অনশনে সংহতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা।