ঢাকা শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩১


উহানে করোনা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ৩শ বাংলাদেশি


২৭ জানুয়ারী ২০২০ ১২:৩৫

আপডেট:
১০ মে ২০২৪ ০৭:৫৬

ঢাকা: কমপক্ষে ১২টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের যাত্রা শুরু চীনের উহান শহর থেকে। সেই শহরেই এখনো অবস্থান করছেন প্রায় তিন শতাধিক বাংলাদেশি, যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে থাকায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন তারা। চীনা নববর্ষের ছুটি আর ভাইরাসের কারণে উহানকে ‘লকড ডাউন’ ঘোষণা করায় স্বাভাবিক জীবনেও ব্যাঘাত ঘটছে তাদের। রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হয় কি না। ফিরতে পারছেন না দেশেও।

এ পরিস্থিতিতে চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরতে চান বাংলাদেশিরা। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মুখে দেশে ফেরাটা কতটা সমীচীন হবে, তা নিয়ে তারা নিজেরাও সন্দিহান।

আর চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, উহানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায় কি না, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চীন সরকারের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে যাচ্ছেন।

রোববার (২৬ জানুয়ারি) রাতে উহান থেকে ফিরে আসা এবং বর্তমানে উহানে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন মাত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, ওই সময়ই দেশে ফিরে আসেন উহানে চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সে (সিইউজে) ল্যান্ড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী ফয়সাল আলম।

উহানে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে তার। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন আজও।

ফয়সাল সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছি। আমার মতো বেশ কয়েকজন দেশে চলে এসেছে আগেই।

এখন ২৫ জনের মতো অবস্থান করছে উহানে। ওদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানতে পেরেছি, বাংলাদেশিসহ প্রায় ৩০০ বিদেশি শিক্ষার্থী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে আছে

। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকায় অফিশিয়াল যারা, তাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেকেই এখনো ক্যাম্পাসে আছেন এবং তারা সবার খোঁজখবর রাখছেন।

আমি যতটুকু জানতে পারলাম, চীন সরকারের পক্ষ থেকে ওখানকার সবার জন্য মাস্ক দেওয়া হয়ছে। ক্যাম্পাস থেকে বাইরে যাওয়ার সময় ও ক্যাম্পাসে ফেরার সময় শরীরের তাপমাত্রা নেওয়া হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনিনি। তবু যেভাবে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সবার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তো রয়েছেই।

উহানে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু সমস্যার মুখেও পড়তে হচ্ছে বলে জানালেন ফয়সাল। তিনি বলেন, চীনা নববর্ষ উপলক্ষে এই সময়টাতে এমনিতেই শপিং মল, দোকানপাট সব বন্ধ থাকে।

করোনাভাইরাসের কারণে বলতে গেলে প্রায় সব দোকানই এখন বন্ধ রয়েছে। কেবল চংপাই সুপারশপ খোলা আছে। সেখানেও সকাল ১০টা বা ১১টার মধ্যেই বাজার শেষ হয়ে যাচ্ছে।আ

র সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, করোনাভাইরাসের কারণে সব ধরনের ট্রান্সপোর্ট বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবেই ওখানে যারা আছেন, তাদের কিছু সমস্যা হচ্ছেই।

ফয়সাল জানালেন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে আরও বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিতেই কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (হাস্ট), সেন্ট্রাল চায়না গভর্নমেন্ট ইউনিভার্সিটি (সিসিএনইউ), চংন্যাম ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, উহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, উহান মেডিকেল, উহান নরমাল ইউনিভার্সিটি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই পিএইচডি করছেন, যারা পরিবার নিয়েই থাকেন। সব মিলিয়ে উহান শহরে পাঁচ থেকে ছয়শ বাংলাদেশির বসবাস।

চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সেই এমবিএ করছেন মিরপুরের ছেলে নাসিম আহমেদ। তিনি এখন উহানেই অবস্থান করছেন। মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে।

নাসিম বলেন, নববর্ষের এই সময়ে এমনিতেই দোকানপাট সব বন্ধ থাকে। এখন ওই এক চংপাই ছাড়া আর কোনো দোকানই খোলা নেই। তবে আমাদের ভার্সিটি বন্ধ থাকায় ইন্টারন্যাশনাল অফিস বন্ধ থাকার কথা থাকলেও বেশ কয়েকজন শিক্ষক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

আমাদের ক্যান্টিন বন্ধ ছিল, কিন্তু পরে খুলে দেওয়া হয়ছে। সকাল ৯টা থেকে ১১টা ও বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকছে ক্যান্টিন। সব মিলিয়ে আমরা আছি একরকম।

নাসিম জানালেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ জনের মতো বাংলাদেশি অবস্থান করছেন ক্যাম্পাসে। চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে উইচ্যাট গ্রুপ খোলা হয়েছে। সেখানে উহানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যুক্ত হয়েছেন। নিজেদের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন সেখানে, দূতাবাসও সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছে।

নাসিম মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে উহানে থাকাই হয়তো তাদের জন্য নিরাপদ হবে। কারণ সেখানে কোনোভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এই ভাইরাস সুপ্ত আকারে শরীরে বয়ে দেশে নিয়ে আসার পর তা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হয়তো ভয়াবহ হবে। বরং সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও দূতাবাস যেভাবে তাদের দেখভাল করছে, সেটাই হয়তো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হবে। তারপরও করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক যে কিছুতেই কাটছে না— সেটিও জানালেন তিনি।

হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (হাস্ট) ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী মো. আবু সায়িদ পলাশ শুরুই করলেন ‘আতঙ্কের মধ্যে আছি’ বলে।

মোবাইল ফোনে পলাশ বলেন, ২৩ তারিখ থেকে ‘লকড ডাউন’ অবস্থায় আছি। চীনা নববর্ষ ঘিরে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ থাকার কথা ছিল এমনিতেই, ভাইরাসের কারণে অন্য দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা দুয়েকটা দোকান খোলা আছে।

পলাশ জানান, হাস্টে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ৭০ থেকে ৮০ জন বাংলাদেশি থাকেন। ছুটিতে তাদের অর্ধেকেরও বেশি দেশে চলে এসেছেন। সবমিলিয়ে এখন ৩৫ জনের মতো আছেন। আর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রয়েছেন দুই শতাধিক। করোনা ভাইরাসের কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে।

পলাশ জানালেন, তাদের যে খাবার আছে, তাতে হয়তো আরও সপ্তাহখানেক চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যান্টিন খোলা আছে, সেখানে কিছু খাবার মিলছে। তবে শিশুদের খাবার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে এবং এ সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

দূতাবাসের উইচ্যাট গ্রুপে যুক্ত রয়েছেন বলে পলাশও জানালেন। তিনি বলেন, দূতাবাসের সঙ্গে ওই গ্রুপের মাধ্যমেই যোগাযোগ আছে। রাষ্ট্রদূত, ফার্স্ট সেক্রেটারিসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই গ্রুপে আছেন। আমরা বাংলাদেশিরা নিজেদের খোঁজখবর নিতে পারছি গ্রুপটির মাধ্যমে।

তবে ওই অর্থে দূতাবাস থেকে যে আমাদের জন্য খুব একটা সহায়তা করা হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। আমাদের খাবার সংকটসহ অন্য যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, দূতাবাসের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করা।

 

অন্যদের মতো দেশ ফিরতে চান পলাশও। দূতাবাসের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলেও দূতাবাসের পক্ষ থেকে আশ্বাস ছাড়া আর কিছু মেলেনি বলে অভিযোগ পলাশের।

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। সারাবাংলার পক্ষ থেকে কথা হয় সেই হটলাইনে। কর্তব্যরত কর্মকর্তা অবশ্য শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অস্বীকার করলেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। আমরা দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমাদের শিক্ষার্থী আছে, এমন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করেছি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিগুলোতে ডিজইনফেকট্যান্ট স্প্রে করা হয়েছে। আমরা উইচ্যাটেও গ্রুপ খুলে ওখানে অবস্থানরত সবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি আমরা চীন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক শেয়ার করছি।

দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উহান স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার পর্যাপ্ত সংস্থান নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ থাকায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে, তা অস্বীকার করার উপয় নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে এরকম কিছুটা সমস্যা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন হটলাইনের অপরপ্রান্তে থাকা ওই কর্মকর্তা।

উহানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, তাদের কিভাবে বের করে দেশে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি, তারা সময় নিচ্ছে। এছাড়া আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি। এখন পর্যন্ত কোনো দূতাবাসই তাদের কোনো নাগরিককে উহান থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারেনি। আমরা আশা করছি, কোনো ধরনের সুযোগ তৈরি হলেই আমরা বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাব