ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ই জুন ২০২৫, ৪ঠা আষাঢ় ১৪৩২


ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংসের সক্ষমতা কি ইসরায়েলের আছে


১৪ জুন ২০২৫ ১২:৪০

আপডেট:
১৭ জুন ২০২৫ ২০:০৪

ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ, প্রায় ২০০ যুদ্ধবিমান শুক্রবার ভোর থেকে দুই দফায় ইরানের ওপর হামলা চালায়। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে অকার্যকর করা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা এবং নাতাঞ্জ ও ফোরদোর মতো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষতিসাধন করা।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যত দিন লাগে’ তত দিন এই হামলা চলবে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করা। অঘোষিতভাবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে সম্ভাব্য ‘পারমাণবিক অস্ত্রধারী’ ইরানকে নিজ অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে আসছে।

নেতানিয়াহুর ঘোষণা ইঙ্গিত দেয় যে, হামলার সময়সীমা এই হামলার সামরিক উদ্দেশ্য এবং ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে। তেহরান এরই মধ্যে ইসরায়েলে শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিশোধ নিয়েছে এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জোন অল্টারম্যান বলেছেন, ‘বড় প্রশ্ন হলো, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে ধীর করবে নাকি ত্বরান্বিত করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের যুক্তি হলো, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে ইসরায়েল এভাবে হামলা চালিয়ে যেতে পারে। তবে ইরান হয়তো পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ডিটারেন্ট) গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

ইসরায়েল শুক্রবার জানিয়েছে, তারা নাতাঞ্জে হামলা চালিয়েছে এবং স্থাপনাটির ভূগর্ভস্থ কাঠামোর ‘ক্ষতি’ করেছে। এই স্থাপনাটি বহুস্তরবিশিষ্ট পরমাণু সমৃদ্ধকরণ এলাকা যেখানে সেন্ট্রিফিউজ, বৈদ্যুতিক কক্ষ এবং অন্যান্য অবকাঠামো রয়েছে। ইসরায়েল ফোরদোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে কিনা, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

এই দুই পারমাণবিক স্থাপনাকে এমন হামলার বিষয়টি মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। ফোরদো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং নাতাঞ্জ ও ফোরদো উভয়ই কয়েক ডজন মিটার পুরু রিইনফোর্সড কংক্রিটের স্তরের নিচে অবস্থিত। এমন কাঠামো ধ্বংস করতে হলে ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমার ধারাবাহিক আঘাত প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘ম্যাসিভ অরডিন্যান্স পেনিট্রেটর’ বহন করতে পারে। এগুলো এ ধরনের হামলার জন্যই তৈরি। তবে ইসরায়েলের সক্ষমতা সীমিত। ইসরায়েলের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান ৪-৫ হাজার পাউন্ডের জিবিইউ-২৮ বাঙ্কার-বাস্টার বোমা বহন করতে পারে, যার প্রতিটি ৫-৬ মিটার কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম। ইসরায়েলের কাছে এই ধরনের বোমা থাকলেও, এর সংখ্যা কঠোরভাবে গোপন এবং খুব কম বিশ্লেষকই মনে করেন যে, দেশটির কাছে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট বোমা আছে।

জিউইশ ইনস্টিটিউট ফর দ্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি অব আমেরিকার গবেষক ও মার্কিন বিমানবাহিনীর সাবেক জেনারেল চার্লস ওয়াল্ড গত এপ্রিলে বলেছিলেন, ইসরায়েলের কাছে ফোরদো এবং নাতাঞ্জ ধ্বংস করার জন্য ‘যথেষ্ট ৫ হাজার পাউন্ডের বোমা নেই।’

ইসরায়েলের কাছে বিএলইউ-১০৯ দুই হাজার পাউন্ডের অরডিন্যান্স পেনিট্রেটর বোমা অনেক আছে। এগুলো এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার দিয়ে বহন করা যায়। এই বোমাগুলো ২০২৪ সালের অক্টোবরে বৈরুতে একটি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে সেই হত্যাকাণ্ডে একাধিকবার হামলা চালানোর প্রয়োজন হয়েছিল বলে জানা গেছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সুরক্ষিত রাখা রিইনফোর্সড বাঙ্কারগুলো ভেদ করতে আরও অনেক বেশি আক্রমণ দরকার হবে।

ইসরায়েল দূরপাল্লার অস্ত্র—ফাইটার জেট থেকে উৎক্ষেপণ করা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র—দিয়েও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ইরানের অবশিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আসার দরকার পড়বে না। তবে শুধু এইগুলো দিয়েই যথেষ্ট হবে না।

লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) সামরিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ম্যাথিউ স্যাভিল বলেছেন, ‘তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। তবে তাদের পক্ষে একা সবকিছু ধ্বংস করা কঠিন। আমি মনে করি, তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আঘাত হানতে প্রস্তুত।’

ইস্পাহান শহরের কাছে নাতাঞ্জ এবং কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে নির্মিত ফোরদো ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রধান কেন্দ্র এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অকার্যকর করার লক্ষ্যে ইসরায়েলের বিমান হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

উভয় স্থাপনাতেই হাজার হাজার সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে যা বিভিন্ন গ্রেডের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ইরান ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বিশাল মজুত তৈরি করেছে। এগুলোকে আর সামান্য সমৃদ্ধ করলেই অস্ত্র তৈরির স্তরে অর্থাৎ, ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ করার স্তরে পৌঁছানো সম্ভব।

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) মে মাসে অনুমান করেছিল, ইরান মোট ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ইউরেনিয়াম মজুত করেছে। নাতাঞ্জ এবং ফোরদোর উন্নত সেন্ট্রিফিউজগুলো প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৩৩ কেজি ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির (আইএসআইএস) চলতি মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, ‘ব্রেক আউট’ হতে অর্থাৎ, প্রয়োজনীয় স্তরে পৌঁছাতে ৩ সপ্তাহ সময় লাগবে, যা ‘নয়টি পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য যথেষ্ট।’

আইএসআইএস—এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বেশির ভাগ মজুত সম্ভবত ইস্পাহানের ফুয়েল প্লেট ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্টে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। রুসির পারমাণবিক অস্ত্রের বিশেষজ্ঞ দারিয়া দলজিকোভা বলেছেন, ‘ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা কঠিন হবে।’

তিনি বলেন, ‘নাতাঞ্জ ইরানের একমাত্র সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নয়। দেশটির সবচেয়ে সুরক্ষিত সাইট—ফোরদো—এখনো অক্ষত এবং দেশের আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাও অক্ষত রয়েছে।’ দলজিকোভা আরও বলেন, ‘ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তারা সম্ভবত সুরক্ষিত এবং সম্ভবত এখনো গোপন স্থানগুলোতে তা করে যাবে।’

আইএইএ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তবে ২০২৩ সাল থেকে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য জানায়নি। আইএসআইএস-এর প্রেসিডেন্ট ডেভিড অ্যালব্রাইট বলেছেন, ‘সত্যি হলো, আমরা জানি না ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ (ইউরেনিয়াম মজুত) কোথায় আছে।’

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাকে নিষ্ক্রিয় করার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছাড়াও, ইসরায়েল বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতা, রাজনীতিবিদ এবং বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিও রয়েছেন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েলের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনও থাকতে পারে, যদিও তারা স্পষ্টভাবে এটি বলেনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসরায়েল একা এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর কোনটিই অর্জন করতে পারবে না। মার্কিন সামরিক ইতিহাসবিদ এবং বিংশ শতাব্দীর বোমা হামলার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা ‘বম্বিং টু উইন’—এর লেখক রবার্ট পেপ বলেছেন, ‘ইসরায়েলের বিমান শক্তি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সিদ্ধান্তমূলকভাবে ধ্বংস করতে পারবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই হামলার পর ইরানের পারমাণবিক প্রতিশোধের ভয় অবশ্যই বাড়বে এবং সম্ভবত ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যেমনটি ঘটেছিল, তেমনই একটি স্থলযুদ্ধের সূচনা হতে পারে।’ তিনি আরও সতর্ক করেছেন যে, ইসরায়েলের কোনো বিমান বোমা হামলা একা তেহরানের সরকার পরিবর্তনে সফল হবে না, যদি এটি ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে সংক্ষেপিত