ঢাকা শনিবার, ২৮শে জুন ২০২৫, ১৫ই আষাঢ় ১৪৩২


এক রাতেই কোটিপতি হওয়া সুশীল আজ নিঃস্ব


২৮ জুন ২০২৫ ১৮:০৬

আপডেট:
২৮ জুন ২০২৫ ২২:৫০

২০১১ সালে বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ (কেবিসি)-তে অংশ নিয়ে ৫ কোটি রুপি জিতেছিলেন সুশীল কুমার। ছবি : সংগৃহীত

ভাগ্য কখন কাকে, কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়- তা কেউ বলতে পারে না। কেউ এক রাতেই রাজা হয়ে ওঠেন, তো কেউ সব হারিয়ে নামেন শূন্যতায়। বিহারের সুশীল কুমার সেই দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ (কেবিসি)-তে অংশ নিয়ে এক রাতেই ৫ কোটি রুপি জিতেছিলেন তিনি। তবে হঠাৎ কোটিপতি বনা সেই যুবক এখন ‘ভিখারি’।

২০১১ সালে বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ (কেবিসি)-তে অংশ নিয়েছিলেন সুশীল। অমিতাভ বচ্চনের প্রশ্নের পর প্রশ্নে দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী উত্তর দিয়ে ইতিহাস গড়লেন তিনি। প্রথমবারের মতো কেউ এই শো থেকে জিতলেন পাঁচ কোটি রুপি।

সেই মুহূর্তেই বদলে যায় তার জীবন। আলো ঝলমলে টেলিভিশনের ক্যামেরা, মিডিয়ার আগ্রহ, এলাকার মানুষের ভালোবাসা- সব মিলিয়ে সুশীল হয়ে ওঠেন এক রকমের তারকা। তিনি শুধু টিভি পর্দার নয়, হয়ে ওঠেন বিহারের গর্ব।

তারকাখ্যাতির স্বাদ পান হঠাৎ করে। দূরদূরান্ত থেকে তাকে অনুষ্ঠানে ডাকা হতে থাকে। লোকজন ঘিরে ধরত, প্রশংসা করত, উপহার দিত। মিডিয়ায় মুখ দেখে প্রতিদিন যেন নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কার করতেন সুশীল।

কিন্তু এই হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি ও সম্পদ তার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে যেন হয়ে উঠেছিল অভিশাপ। তখন তিনি ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, স্বপ্ন ছিল আইএএস হবেন। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা হাতে আসার পর সেই স্বপ্ন অনেকটা চাপা পড়ে যায়।

তিনি নিজেই ২০২০ সালে এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘যখন ১০-১৫ দিন অন্তর অনুষ্ঠানের ডাক আসত, তখন আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’

ধীরে ধীরে সংবাদপত্রে নিজের নাম খোঁজাই হয়ে ওঠে তার প্রতিদিনের অভ্যাস। লাইমলাইট এতটাই আপন হয়ে যায় যে বাস্তব জীবনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে।

তারকা হওয়ার পর যে কেউ তাকে যে কোনো বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলে তিনি তাতে সায় দিতেন। কে বিশ্বাসযোগ্য আর কে নয়, সে যাচাই না করেই ঢালতে থাকেন টাকা। পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বড় অঙ্কের অর্থ দান করতেন, যেন উদারতার প্রতিমূর্তি।

এই অতিরিক্ত খরচ, বিনিয়োগে না বুঝে ঝাঁপ দেওয়া, পরিবারের প্রতি অবহেলা- সব মিলিয়ে দ্রুতই তার আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে।

সুশীল তখন আর সেই আগের মানুষটি ছিলেন না। আত্মীয়-পরিজনের কাছে হয়ে ওঠেন অচেনা, পরিবার থেকে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ে। একপর্যায়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই তলানিতে ঠেকে যে, তিনি রাগ করে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

সব হারিয়ে একসময় জীবিকা নির্বাহের জন্য গরুর দুধ বিক্রি করা শুরু করেন সুশীল। ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বর্তমানে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন।

ছবিনির্মাণেও একবার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, ভাবছিলেন পরিচালনায় হাত দেবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এমনকি এক সময় সিগারেট ও মদের মতো আসক্তিতেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।

তার ২০২০ সালের ফেসবুক পোস্টে এক চরম আত্মস্বীকারোক্তি ছিল। সেখানে তিনি লেখেন, ‘অনেকেই আমাকে সাবধান করেছিল, বিশেষ করে আমার স্ত্রী। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বলত। কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। বরং এ নিয়ে ঝগড়া করতাম। পরে বুঝলাম, আমি ভুল ছিলাম।’

যিনি একসময় ছিলেন মিডিয়ার চোখের মণি, এখন তিনি সেই আলোর উৎস থেকে বহু দূরে। পরিচিত কাউকে দেখলে এড়িয়ে চলেন, সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে বিরক্ত হন।

সুশীল কুমারের গল্পটা কেবল একজন মানুষের উত্থান ও পতনের কাহিনি নয়, এটা আমাদের সবার জন্য এক সতর্কবার্তা। হঠাৎ পাওয়া সম্পদ, খ্যাতি বা সাফল্য তখনই দীর্ঘস্থায়ী হয়, যখন তার সঙ্গে যুক্ত থাকে পরিপক্বতা, সংযম ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা।

সুশীল হারিয়ে গেছেন, কিন্তু তার গল্পটা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

সূত্র : আনন্দবাজার