ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


‘সাধের’ ৩৭ লাখ টাকার পর্দা নষ্টের পথে


২ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:২৩

আপডেট:
৯ মে ২০২৫ ০৫:০৩

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য কেনা বহুল আলোচিত সেই সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দামের সেই পর্দাসহ দামি যন্ত্রপাতি বর্তমানে হাসপাতালের মেঝেতে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনুসন্ধান এবং সম্প্রতি দুদকের করা মামলার অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বড় অঙ্কের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দুর্নীতিতে কাগজে-কলমে তিনটি প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার কথা বলা হলেও নেপথ্যে থেকে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই পরিচালনা করেন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন। নিজের ভাইদের নামে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে তিনি ফমেকের কেনাকাটায় দরপত্র দাখিল করেন। এরপর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গঠিত যাচাই কমিটির তৈরি ভুয়া কোটেশন দাখিল করে আকাশচুম্বী মূল্যে পর্দাসহ নানা মালামাল কেনা হয়। হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট বিভাগ চালু না থাকলেও কেনা হয় ওইসব যন্ত্রপাতি।

ফমেকে কেনাকাটায় বড় ধরনের ওই দুর্নীতির ঘটনায় দুদকের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়। এতে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন, তার ভাই সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মুন্সি ফররুখ আহমেদ, ফমেক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (দন্ত বিভাগ) ডা. গণপতি বিশ্বাস শুভ, ফমেক হাসপাতালের সাবেক জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. মিনাক্ষী চাকমা ও ফমেক হাসপাতালের সাবেক প্যাথোলজিস্ট ডা. এএইচএম নুরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।

এই দুর্নীতিতে ফমেক হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক (উপপরিচালক) ডা. ওমর ফারুক খানের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেও মৃত্যুবরণ করায় তাকে মামলার আসামি করা হয়নি।

দুদকের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ফমেকের কেনাকাটায় দরপ্রস্তাব জমা দেয় তিনটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স এবং মেসার্স আলী ট্রেডার্স।

এর মধ্যে মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেনের ভাই মুন্সি ফররুখ হোসাইনের, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স মুন্সি সাজ্জাদের আরেক ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুনের এবং মেসার্স আলী ট্রেডার্স সাজ্জাদেরই এক ভগ্নিপতির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।

তবে কাগজে-কলমে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা ব্যক্তির মালিকানাধীন দেখানো হলেও বাস্তবে দরপ্রস্তাব জমা দেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানই সাজ্জাদ হোসেন পরিচালনা করেন। ফমেক হাসপাতালে এমএসআর খাতে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হলে মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে সাজানো দরপত্র দাখিল করেন।

দুদকের মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, ফমেক হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ডা. মো. ওমর ফারুক খান ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো প্রকার প্রাক্কলন ছাড়াই এসব যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেন।

এরপর হাসপাতালের দন্ত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গণপতি বিশ্বাস, তৎকালীন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মিনাক্ষী চাকমা ও প্যাথলোজিস্ট ডা. এএইচএম নুরুল ইসলামকে বাজারদর সংগ্রহ ও যাচাই কমিটির সদস্য নিয়োগ করেন। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বরাবর দাখিল করা তিনটি কোটেশনের ভিত্তিতে ওই কমিটি ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর বাজারদর প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে কোটেশনগুলো ভুয়া ও সাজানো বলে প্রমাণ হয়।

দুদকের তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফমেক হাসপাতালের চাহিদার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এমএসআর খাতে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ বাবদ ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ফমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স এবং মেসার্স আলী ট্রেডার্স দরপত্র দাখিল করে। ফমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সভাপতিত্বে গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ও আর্থিক মূল্যায়ন কমিটি ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের দরকে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত দর হিসেবে গ্রহণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর সর্বনিমœ দরদাতা হিসেবে মেসার্স অনিক ট্রেডার্সকে একটি ভিএসএ অন সাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্লান্ট, ছয়টি অটোমেটিক স্ক্রাব স্টেশন, একটি হসপিটাল কারটেইন সিস্টেম ফর আইসিইউ/সিসিইউ বেড, তিনটি ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার সিস্টেম, একটি ভ্যাকুয়াম প্লান্ট মেশিন, একটি সাকার মেশিন, ২০টি ডাউন স্ট্রিম ইকুইপমেন্ট, একটি বিআইএস মনিটরিং সিস্টেম, চারটি থ্রি হেড কার্ডিয়াক স্টেথেস্কোপ এবং দুটি ফাইভার অপটিক ল্যারিঙ্গোসকোপ সেটমেকিনটোস সরবরাহের জন্য ১০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই কার্যাদেশ পেয়ে মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এবং ২০ ডিসেম্বর আলাদা দুটি চালানে এসব মালামাল সরবরাহ করেন। পরে সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির দাম হিসেবে ৭ কোটি ৬০ লাখ ও ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার দুটি আলাদা বিলসহ মোট ১০ কোটি টাকার বিল দাখিল করেন। আর সরবরাহ করা এসব যন্ত্রপাতি সার্ভে কমিটি গ্রহণও করে।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ভ্যাকুয়াম প্লান্ট মেশিনের স্পেসিফিকেশনে ক্যাপাসিটি সেভেন পয়েন্ট এইচপি থাকলেও মেশিনের প্যানেলে রেটিং দেওয়া আছে ফাইভ এইচপি। অর্থাৎ ভ্যাকুয়াম প্লান্ট মেশিনটি দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। এছাড়া এ ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি যেই কোডে কেনা হয়েছে, সাধারণত সেই কোডে এসব মালামাল কেনা যায় না। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ফমেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে চিকিৎসক, এমনকি চতুর্থ শ্রেণির কোনো কর্মচারী পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। জনবলের অভাবে আইসিইউ বিভাগ চালু করা যায়নি। অথচ বিভাগ চালু না থাকলেও অস্বাভাবিক দামে পর্দাসহ বিভাগের যাবতীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আর কেনার পর দীর্ঘদিনেও ব্যবহার না হওয়ায় ওইসব যন্ত্রপাতি এখন নষ্ট হওয়ার পথে।

দুদকের ফরিদপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধভাবে উচ্চমূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে সরকারের দশ কোটি টাকা আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।’

এদিকে বিপুল টাকায় সরঞ্জাম কেনার পর তা ব্যবহার না করে ফেলে রাখার কারণ জানতে চাইলে ফমেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আফজাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু দুদক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তাই দুদকের নির্দেশনার বাইরে আমরা ওই যন্ত্রপাতিতে হাত দিতে চাই না। এজন্য সেগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা আছে।’