ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩২


শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

ইয়াবার নতুন ট্রানজিট রুট!


৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:১৪

আপডেট:
৯ মে ২০২৫ ০৭:২২

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানেও থেমে নেই ইয়াবার কারবার। গ্রেফতার এড়াতে নিত্যনতুন কৌশলে সক্রিয় রয়েছে কারবারিরা। অতীতে সড়ক ও নৌপথে ইয়াবা পাচার বেশি হলেও এখন আকাশপথকে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে বেছে নিয়েছে কারবারিরা। পেটে ও গোপনাঙ্গের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় বহন করা হচ্ছে ইয়াবা। বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এসব বহনকারীদের। পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে। গত দেড় বছরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭৪ জন ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এ সময় দেড় লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ছিঁচকে বহনকারীরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় মূল হোতারা। ইয়াবা কারবারিরা শাহজালালকে নিজেদের রুট বেছে নেওয়ায় এখন প্রশ্ন জাগছেÑ শাহজালাল কি ইয়াবা বহনের ‘ট্রানজিট রুট’ হতে চলেছে?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, অতীতে সড়ক, রেল ও নৌপথকে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর এসব পথে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে কৌশল বদলে আকাশপথকে নতুন রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে কারবারিরা। এ ক্ষেত্রে শাহজালাল বিমানবন্দরকে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী ইয়াবার মতো সামগ্রী সহজেই শনাক্তকরণে তেমন কোনো আধুনিক ব্যবস্থাপনা দেশের কোনো বিমানবন্দরেই নেই বলে জানা যায়।

বিমানবন্দরগুলোয় স্ক্যানিং বা এক্স-রে ব্যবস্থাপনা আরও অত্যাধুনিক করার তাগিদ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

রোববার রাতে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ইয়াবাসহ মো. শাহিন (৩৫) নামে এক যাত্রীকে আটক করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এএপি)। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে তার পাকস্থলী থেকে ২ হাজার ৯০৫ পিস ইয়াবা বের করা হয়।

এএপি সূত্র জানায়, শাহিনের গতিবিধি সন্দেহ হলে তার দেহ তল্লাশি ও এক্স-রে করে পাকস্থলীতে ইয়াবার অস্তিত্ব ধরা পরে। পরে ১৫ ঘণ্টার চেষ্টায় ইয়াবাগুলো বের করা হয়। জব্দকৃত ইয়াবার বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শাহিন পুলিশকে জানিয়েছে, কক্সবাজার থেকে নভোএয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসে সে। কক্সবাজারের সেলিম নামে এক ব্যক্তি তাকে ইয়াবাগুলো দিয়েছে। টঙ্গীর চেরাগ আলীর হাবিবের কাছে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ইয়াবাগুলো বহনের জন্য সে নিযুক্ত ছিল বলে জানায়।

এএপি জানিয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত শাহজালাল থেকে ইয়াবা সংশ্লিষ্টতায় ৭৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০ জন নারী রয়েছে। এসব যাত্রীর দেহ তল্লাশি করে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৪৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৩টি। এ ছাড়া বিমানবন্দরে দায়িত্বরত অন্য সংস্থাও বিভিন্ন সময়ে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক জব্দ করেছে।

বিমানবন্দর এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন শিমুল সময়ের আলোকে বলেন, গ্রেফতাররা বিমানবন্দরের বিভিন্ন ফ্লাইটের যাত্রী। তাদের মধ্যে নারী মাদক কারবারিও রয়েছে। এসব নারীরা পেটে বা যৌনাঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ইয়াবা বহন করে। নারীদের মতো পুরুষরাও পায়ুপথ ও পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করেন।

তিনি আরও বলেন, পেটে করে ইয়াবা পাচারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৫০টির মতো ইয়াবা স্কচটেপে পেঁচিয়ে জামের আকৃতির প্যাকেট বানানো হয়। এ রকম ইয়াবাভর্তি ৩০ থেকে ৪০টি প্যাকেট গলা দিয়ে গিলে পাকস্থলীতে ঢোকানো হয়। পরে ঢাকায় পৌঁছে পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবার প্যাকেটগুলো বের করে।

বিমানবন্দরে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, স্ক্যানার মেশিনে খুব সহজে স্বর্ণ বহনের বিষয়টি ধরা পড়লেও ইয়াবা ধরা পড়ে না। এক্স-রে মেশিন ছাড়া কোনোভাবে ইয়াবা শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে যেভাবে নজরদারি করা হয় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সেভাবে নজরদারি না করায় পাচারকারীরা খুব সহজে শাহজালালকে ট্রানজিট হিসবে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে।

এএপির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শাহজালাল থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৫৫ হাজার ৫৪৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২টি। এ ছাড়া চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৪ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময়ে ইয়াবা পাচারের দায়ে গ্রেফতার করা হয় ৪৪ জনকে ও ৪৩টি মামলা হয়েছে। একই তথ্যে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত আড়াই বছরের বেশি সময়ে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ৬০ হাজার ৮৩০ পিস ইয়াবা উদ্ধার আর গ্রেফতার করা হয় ৪১ জনকে। তাদের মধ্যে অর্ধেক পাচারকারী পেটে ইয়াবা বহন করে ঢাকায় যাওয়ার সময় গ্রেফতার হন।

এএপির তথ্যে আরও দেখা যায়, গত বছর ৩০ জুলাই রিমা ঘোষ নামে কক্সবাজার থেকে আসা এক নারী যাত্রীকে আটক করে পুলিশ। তার কোমরে বিশেষ কৌশলে লুকানো অবস্থায় ১৮৪৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। চলতি বছর ২৫ জানুয়ারি ইশা নামে আরেক নারী যাত্রীকে আটক করে তার যৌনাঙ্গ থেকে ৭২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ১৬ ফেব্রুয়ারি নারী যাত্রী রুনা বেগমকে আটক করে তার পেটের ভেতর থেকে ১৬০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া এ বছর অন্তত ৫ জন নারী পেট বা গোপনাঙ্গে ইয়াবা বহন করেছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা বহনকারীদের ধরা হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ ছাড়া গ্রেফতার কারবারিরা স্বল্প সময়ে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজ শুরু করে। এর বাইরে এসব মামলার তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগায় শাস্তির নজিরও খুবই কম।