ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩২


জরুরি সেবার ২৫ মাস

ভরসার প্রতীক ট্রিপল নাইন


২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৫৮

আপডেট:
৯ মে ২০২৫ ১৬:৫৭

বিপন্ন মানুষের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে তারা সাহায্যের জন্য ফোন করে এ নম্বরে। মানুষের ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্রিপল নাইন।
বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে গত ১৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারের রামুতে ঘুরতে যান এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণী। রামুর প্যাঁচার দ্বীপ এলাকার ‘গুডভাইভ কটেজ’ নামের একটি রিসোর্টে ওঠেন তিনি। রাতে নিজের কক্ষে একাকী ঘুমিয়েছিলেন। মধ্যরাতে স্থানীয় কয়েকজন যুবক গোপনে কটেজের জানালা দিয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় তাকে। তবে তিনি চিৎকার করলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে রক্ষা হয় তার। পরবর্তী সময়ে তাদের পরামর্শে এরপর জাতীয় জরুরি সেবার ‘৯৯৯’ নম্বরে কল করলে তাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়।

১৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা থেকে ৯৯৯-এ কল করে নিজের প্রতিবন্ধী ছেলে হারিয়ে যাওয়ার তথ্য জানান এক বাবা। এক দিন পরে রবিউল আলম (১৬) নামের ওই কিশোরকে উদ্ধার করে বাবার হাতে তুলে দেয় চৌদ্দগ্রাম থানা পুলিশ। রবিউল জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার মালনচর গ্রামের মজিবুল হক মিজানের ছেলে।

এমন একটি বা দুটি ঘটনা নয়, বর্তমানে জাতীয় সেবার ‘৯৯৯’ নম্বরে কল করে দ্রুত অনেক সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন নাগরিকরা। ফলে দিনে দিনে এ সেবা মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। গ্রাম থেকে শহর, নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চবিত্ত সব শ্রেণির নাগরিক এ সেবার সুফল ভোগ করছেন। পুলিশি সহযোগিতা, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া ও নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজেন কল করে মিলছে এ সেবা। আবার মাঝেমধ্যে যথাযথ সেবা না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও সেবার পরিধি বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।

ডিসেম্বরের শুরুতে যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের কদবানু বেগমের মেয়ে আছিয়া খাতুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। তাদের বাসার পাশে একটি কারখানায় মধ্যরাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে লোহার ফার্নিচার তৈরির কাজ করায় ঘুমাতে পারছিলেন না কেউ। পরে ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিলে স্বস্তি মেলে পরিবারটির।

আবার সেবা না পেয়ে বিক্ষুব্ধ এক সাংবাদিক বলেন, বৃষ্টির সময় মতিঝিল এলাকায় রাষ্ট্রপতির বাসার সামনের রাস্তা ডুবে ম্যানহোলের ভেতরে রিকশাসহ বিভিন্ন যান পড়ে যাচ্ছিল। সে সময় ৯৯৯ নম্বরে কল করে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সেবা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর সেবা চালুর পর চলতি মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত (২৫ মাসেরও বেশি সময়) ‘৯৯৯’ থেকে জরুরি সেবা দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৮টি। এর মধ্যে পুলিশি সেবা দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭১৪টি (৭২ শতাংশ)। ফায়ার সার্ভিসের সেবা দেওয়া হয়েছে ২৭ হাজার ৬৯৫টি (১৬ শতাংশ)। আর অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া হয়েছে ২১ হাজার ১৪৯টি (১২ শতাংশ)।

সূত্র আরও জানায়, সেবা চালুর পর ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট কল এসেছে ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৩ হাজার ৩১৪টি। এর মধ্যে সিএফএস (কল ফর সার্ভিস) বা জরুরি কল এসেছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৮টি। ইনকোয়ারি কল এসেছে ২৫ লাখ ৩৪ হাজার ৭২২টি। ডিপার্টমেন্টাল কল ৩৮ হাজার ৩৪৭টি, চাইল্ড ইনকোয়ারি কল ২৮ লাখ ৬ হাজার ৭৫০টি, ওমেন ইনকোয়ারি কল ১ লাখ ৩ হাজার ৫৭৫টি, বø্যাঙ্ক কল ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৯৪টি, ক্র্যাঙ্ক বা প্রাঙ্ক কল ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫৮টি। এ ছাড়া অন্য ক্যাটাগরির কল এসেছে ২৫ লাখ ৯২ হাজার ১০টি।

তথ্যমতে, সব মিলিয়ে সেবা দেওয়া গেছে এমন কলের সংখ্যা ৩১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫২টি। আর কোনো সেবা দেওয়া যায়নি এমন কলের সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬২টি। এই হিসাবে শতকরা ২১ শতাংশ কলারকে সেবা দেওয়া গেছে আর ৭৯ শতাংশ কল সেবা দেওয়ার উপযোগী ছিল না।

সেবা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১১ ডিসেম্বর রাতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী শারমিন আক্তার রুম্পার মৃত্যুর তথ্য প্রথমে ৯৯৯-এ করে জানানো হয়। পরে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। ৩০ নভেম্বর রমনা এলাকায় ডা. ফাতেমা জাহান বারী নামে এক স্ত্রী কল করে নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে তাকে নির্যাতনের কথা জানান। পরে পুলিশ গিয়ে অতিরিক্ত সচিব স্বামী ডা. জাকির হোসেনের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করে। ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট যাওয়ার পথে প্রসব বেদনা উঠলে বগুড়া স্টেশনেই সন্তান প্রসব করেন অসুস্থ প্রসূতি নবিয়া খাতুন (২৮)।

পরে ৯৯৯-এ কল করা হলে তাকেসহ সন্তানকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১১ নভেম্বর নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের সিঙ্গেরগাড়ি গ্রামে যৌতুকের দাবিতে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ঈশিতা আক্তারকে (২৩) নির্যাতন শুরু করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। পরে তিনি ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। ১০ নভেম্বর বরিশালের হিজলা থানার মিয়ারচরের কাছে মেঘনার শাখা নদীতে খনন কাজের একটি ড্রেজারের ৬টি পন্টুন নোঙর করা ছিল।

ঘূর্ণিঝড়ে একটি পন্টুন নোঙর ছিঁড়ে গেলে নদীতে ভেসে যায়। পরে তাদের একজন ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ ও কোস্ট গার্ড অভিযান চালিয়ে ৩০ জনকে উদ্ধার করে। ২১ জুন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার তিন গ্রামের তিনজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্রীর বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ বিয়ে বন্ধসহ ভুক্তভোগী ছাত্রীদের অভিভাবকদের থানায় নিয়ে যায়। ৬ মে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে ২০ বছরের এক তরুণী ৯৯৯-এ কল করে নিজেকে ২৩ দিন ধরে বন্দি রাখার কথা জানান। পরে পুলিশ গিয়ে ঢাকার একটি কলেজে স্নাতকে পড়ুয়া ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে। ভিন্ন ধর্মের ছেলের সঙ্গে প্রেম করায় তাকে আটকে রাখা হয়।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে সহায়তা চেয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৮ শতাংশ কল করা হয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে। এরপর চট্টগাম থেকে ১০ শতাংশ, খুলনা থেকে ৫ শতাংশ, রাজশাহী থেকে ৪ শতাংশ, রংপুর থেকে ৪ শতাংশ, বরিশাল থেকে ২ শতাংশ করে ও সিলেট থেকে সবচেয়ে কম ১ শতাংশ কল করা হয়েছে।
জাতীয় জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন আগেও পুলিশের বিভিন্ন পদ মর্যাদার প্রায় ৪৬৭ জন জনবল ছিল। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা ৩৭০ জন, যা আরও বাড়বে।

এক তথ্যে দেখা যায়, সার্বিক দায়িত্বে একজন অতিরিক্ত ডিআইজি ছাড়াও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৪ জন সহকারী পুলিশ সুপার ও ২২ জন পরিদর্শকসহ বিশাল কর্মীবাহিনী নাগরিকদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কল করে মাঝেমধ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশকে হয়রানিও করে কেউ কেউ। এর মধ্যে ৩০ নভেম্বর ফেনীর সোনাগাজীতে ভুয়া পরিচয়ে চাঁদাবাজির তথ্য দিয়ে ৯৯৯ নম্বরে কল করে এক ব্যক্তি। যদিও ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা মেলেনি। পরে ডলার নামে মিথ্যা তথ্যদানকারী ওই ব্যক্তিকে থানায় ডেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন একটি দুটি নয়, বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে এভাবে হয়রানির ঘটনা ঘটে বলে তারা অভিযোগ করেন।

সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯২টি থানায় মোবাইল ডাটা টার্মিনাল (এমডিটি) স্থাপন করা হয়েছে। এ সেবা দেওয়ার জন্য ২০৪টি থানায় ডেসপাচ সেন্টার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া ডেমরার আমুলিয়ায় একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস সেন্টারের কাজ চলছে। সেখানে সাড়ে ৫০০ কল সেন্টারের মাধ্যমে তিন হাজার জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।

সার্বিক তদারকিতে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. তবারক উল্লাহ বলেন, প্রতিনিয়ত কলারের সংখ্যা বাড়ছে। দ্রুত সময়ে নাগরিকদের সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরিসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে।