শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৭ দিনে ৬২ জনের মৃত্যু!

জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেশের বিভিনড়ব স্থানে গত শনিবার বিকেল থেকে গতকাল রবিবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এনিয়ে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৭ দিনে ৬২ জনের মৃত্যু বলে জানা গেছে।
তাদের মধ্যে গতকাল দুপুরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত আইসোলেশন ওয়ার্ডে ময়না খাতুন (৪৩) নামে এক নারী মারা গেছেন। স্বজনদের দাবি, তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন না এবং বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে গতকাল ভোরে ঝিনাইদহ সদরে ৭৫ বছর বয়সী এক নারী, সকালে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে এক কিশোর ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে এক গৃহবধূ, দুপুরে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক বৃদ্ধ, বিকেলে রাজবাড়ী সদরে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি মারা গেছেন। এর আগে শনিবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে এক বৃদ্ধা এবং রাতে চাঁদপুর সদরে এক ব্যক্তি ও ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া এক সপ্তাহে একই উপসর্গ নিয়ে দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী দেশের বিভিনড়ব স্থানে মারা গেছেন আরও ৬২ জন।
কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তাপস কুমার সরকার জানিয়েছেন, রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ময়না খাতুনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। গত শুক্রবার দুপুরে মিরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রামের ওই নারী ঠাণ্ডা ও জ¦র নিয়ে জরুরি বিভাগে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে তাকে ভর্তি করা হয়। শনিবার তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরের ল্যাবে পাঠানো হয়।
ওই নারীর স্বামী আবদুর রহিম জানান, ১০ মাস আগে জরায়ুর টিউমার অপারেশন করার পর থেকেই ময়না আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি অ্যাজমাসহ মূত্রনালির সংক্রমণে ভুগছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে অসুস্থতা বেড়ে গেলে পরদিন সকালে মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। কিন্তু ওই ওয়ার্ডে তাকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ওই নারীর নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এখনো আমরা জানতে পারিনি। সে কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে মরদেহ দাফন করা হবে। একই সঙ্গে রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত ওই নারীসহ আশপাশের কয়েকটি বাড়ি লকডাউনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে।’ বিনা চিকিৎসায় ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনদের দেওয়া অভিযোগ সঠিক নয় বলেও জানান তিনি।
সাভার : উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সায়েমুল হুদা জানান, গতকাল সকালে সাভার পৌর এলাকার ছায়াবীথি এলাকায় এক কিশোরের মৃত্যুর পর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। দুপুরে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের পর স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে দাফন করা হয়।
১৩ বছর বয়সী আসাদুল ইসলাম রাজাশন মহল্লার কনক হোসেনের ছেলে। তারা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাডিবাড়ী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকত। তার বাবা জানান, দুই-তিন মাস ধরে তার ছেলে নিউমোনিয়ায় ভুগছিল। এক মাস ধরে তার সর্দি-কাশি ও জ্বর ছিল। রবিবার সকালে তার মৃত্যু হয়। সাভার মডেল থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ জানান, পৌর এলাকার রাডিবাড়ী মহল্লায় ওই কিশোরের ভাড়া বাসা লকডাউন করা হয়েছে।
মাদারীপুর : রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. মিঠুন বিশ্বাস জানান, করোনা উপসর্গ নিয়ে রবিবার দুপুর ১টার দিকে উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। পরে দুপুর ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সতর্কতার সঙ্গে তার লাশ দাফন করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএও) সোহানা নাছরিন জানান, ওই ব্যক্তির বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জ : কাশিয়ানীর ইউএনও মো. সাব্বির আহমেদ জানান, রবিবার সকালে বুপাশা গ্রামের সানিয়া বেগম (২০) নামে এক নারী জ¦র ও শ্বাসকষ্টসহ মারা যান। পরে তার মরদেহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তার বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
চাঁদপুর : সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় ও এলাকাবাসী জানিয়েছে, উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা গ্রামে শনিবার বিকেলে মো. ফয়সাল (৪১) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জে এসিআই কোম্পানির উৎপাদন কারখানায় কর্মরত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি মতলব উত্তর উপজেলায়। রাতে মৃতদেহের নমুনা সংগ্রহের পর চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয়।
তারা আরও জানায়, ফয়সাল গত ২৬ মার্চ তার কর্মস্থলে সর্দি, জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হন। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে ১ এপ্রিল তিনি কামরাঙ্গা গ্রামে শ্বাসুরবাড়িতে আসেন। এর মধ্যে আবারও তার সর্দি, জ্বর ও কাশি দেখা দেয়। সেই সঙ্গে রক্তের চাপও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় শনিবার বিকেলে মারা যান তিনি।
চুয়াডাঙ্গা : জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জুলিয়াড পারউইন জানান, জ¦র, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়া নিয়ে রেহেজান বেগম (৬৫) নামের একজন শনিবার বিকেলে উপজেলার হাসদাহ বাসুতিপাড়ায় মেয়ের বাড়িতে মারা যান। পরে রাতে তার নমুনা সংগ্রহ করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওই বৃদ্ধা উপজেলার খয়েরহুদা গ্রামের পূর্ব পাড়ার মৃত আবদুল লতিফের স্ত্রী।
স্থানীয়রা জানায়, কয়েক দিন আগে ঝিনাইদহের মহেশপুর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর ওই বৃদ্ধার সর্দি, কাশি, জ¦র ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। গত শুক্রবার তিনি হাসদাহ এলাকায় মেয়ের বাড়িতে আসেন। পরদিন বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
জীবননগরের ইউএনও সিরাজুল ইসলাম জানান, স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ওই বৃদ্ধার মরদেহ সরকারি নিয়মে দাফন করা হয়। এ ছাড়া তার গ্রামের বাড়ি, মেয়েরটিসহ চারটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
ঝিনাইদহ : সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম জানান, শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জ¦র ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে নাসিমা বেগম (৭৫) নামে একজন মারা গেছেন। তার নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া তার বাড়িটি লকডাউন করেছে উপজেলা প্রশাসন। গতকাল বিকেলে সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, কালীগঞ্জ উপজেলার খাঞ্জাপুর গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ৬ দিন ধরে জ¦র, ঠাণ্ডা ও শ^াসকষ্টে ভুগছিলেন। শনিবার রাতে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে গভীর রাতে তার মৃত্যু হয়। তার দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে তার বাড়িটি লকডাউন করা হয়েছে।
স্থানীয় মাওলানা রুহুল আমীন জানান, জ¦র ও শ্বাসকষ্টনিয়ে মারা যাওয়া ওই ব্যক্তিকে খাটিয়ার ওপর রেখে জানাজা করতে বাধা দেয় গ্রামবাসী। পরে গ্রামের কবরস্থানের সামনে মাটির ওপর রেখে ছয়জন নিযুক্ত আলেম ও মৃতের দুই ভাই জানাজা শেষে তাকে দাফন করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শামীমা শিরিন লুবনা, আরএমও ডা. সুলতান আহম্মেদ ও কোলা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ আবুল কালাম।
রাজবাড়ী : সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস এম এ হানড়বান জানান, রবিবার বিকেল ৩টার দিকে উপজেলার লক্ষ্মীকোল হরিসভা এলাকার বাড়িতে জ্বর-সর্দি ও কাশি নিয়ে সীতানাথ শীল নামে (৫৫) এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তার নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সদর উপজেলার ইউএনও মো. সাইদুজ্জামান খান বলেন, উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে ওই ব্যক্তির সৎকারের জন্য দুজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা নিয়ম মেনে দূরত্ব বজায় রেখে সৎকার করবেন।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুষ্টিয়া, সাভার, গোপালগঞ্জ, চাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি এবং মাদারীপুর সংবাদদাতা)