ঢাকা সোমবার, ১২ই মে ২০২৫, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩২


২৫০ কোটি টাকা নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে মার্কেট খেকো দেলু


১০ ডিসেম্বর ২০২০ ০৬:৩৩

আপডেট:
১২ মে ২০২৫ ১৮:০০

রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটিতে তার নাম নেই। নেই কোনো দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। তবে যে দলই ক্ষমতাসীন হোক, সে দলের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া পান তিনি। এমন সুযোগে গড়ে তোলেন অপরাধ সিন্ডিকেট। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া এলাকার তিনটি মার্কেট নিয়ন্ত্রণে রেখে আয় করেছেন কয়েকশ কোটি টাকা। দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর সূত্রপাতও তার হাত ধরেই। তার প্রকৃত নাম দেলোয়ার হোসেন হলেও সবাই চেনেন ‘ক্যাসিনো দেলু’ হিসেবে। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকা ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে তার পরিচিতি ‘মার্কেট খেকো দেলু’ নামে। এই মার্কেট খেকোর কূটকৌশল ও লোভের বলি হয়ে এখন পথে বসতে চলেছেন ফুলবাড়িয়া এলাকার তিন মার্কেটের ৯১১ দোকানি। অবৈধ দোকান বিক্রি বাবদ কয়েক দফায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেলু এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ফুলবাড়িয়া এলাকার ডিএসসিসির মালিকানাধীন নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও জাকের প্লাজায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল দেলুর। এই তিন মার্কেটে করপোরেশনের অনুমতি ব্যতীত অবৈধভাবে ৯১১টি দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করেন তিনি। এর পর বৈধতা দেওয়ার কথা বলে বছর বছর লাখ লাখ টাকা তোলেন। এ কাজে সহায়তা করেছেন ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তা। বিভিন্ন সময়ে নগর ভবনের শীর্ষ পদের দায়িত্বে থাকাদের নানাভাবে ম্যানেজ করেই ফুলবাড়িয়া এলাকায় সিটি করপোরেশন মার্কেটগুলোয় অলিখিত সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তবে

সেই দোকানের বৈধতা মেলেনি। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ আজ এই তিন মার্কেটের ৯১১টি দোকান উচ্ছেদ করবে। এমন অবস্থায় এসব দোকানের মালিকরা পড়েছেন বিপাকে। করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা, এর সঙ্গে দোকান উচ্ছেদ সব মিলিয়ে পথে বসে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা দাবি করছেন, অন্তত শীত মৌসুম ব্যবসা করতে পারলেও কিছু টাকা জমানো যাবে। পরবর্তী সময়ে ভিন্ন কিছু করে জীবনযাপন করতে পারবেন।

জাকের প্লাজার ব্যবসায়ী ইসরাফিল আরাফাত বলেন, একটি দোকান কিনেছিলাম ৬০ লাখ টাকা দিয়ে। পরবর্তী সময়ে দোকানের সঙ্গে দুই হাত বাড়াতে ২০ লাখ টাকা দিতে হয় দেলোয়ার হোসেন দেলুকে। এর পর সেই অংশের বৈধতার কথা বলে আরও দুবার টাকা নেন তিনি।

একই কথা বলেন সিটি প্লাজার ফুটপাতের দোকানদার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১০ লাখ টাকা দিয়ে দুই হাতের এক শাটারের একটি দোকান ক্রয় করি। পরে এই দোকান স্থায়ী করে দেওয়ার কথা বলে দেলু ১০ লাখ টাকা নেন। কিন্তু এখন দোকান উচ্ছেদ করা হবে। করোনার থাবায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা মন্দা। ধারদেনা করে চলছি। শীত মৌসুমে ব্যবসা হবে ভেবে ধারদেনা করে মাল তুলেছি। এখন উচ্ছেদ করে দিলে আমার পরিবার নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে।

সিটি প্লাজা মার্কেট মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা অন্তত শীতের মৌসুমটা ব্যবসা করার সুযোগ চাচ্ছিলাম। করোনায় এমনিতেই দীর্ঘদিন সবার ব্যবসা বন্ধ ছিল। মার্কেটের বরাদ্দ তো সিটি করপোরেশনই দিয়েছে। অল্প কিছুদিন সময় পেলেও সবাই বেঁচে থাকত।

দোকানিরা নানা স্থানে দেনদরবার করে কাটালেও ওইসব অবৈধ দোকানের বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন দেলুর খোঁজ নেই। প্রতিটি দোকান কেনা বাবদ অর্থ দিলেও আবার দোকান বৈধতার কথা বলে দুই দফায় নিয়েছেন টাকা।

ব্যবসায়ীরা জানান, এক শাটার দোকানের বৈধতার জন্য দেলোয়ার হোসেন দেলুর মাধ্যমে সিটি করপোরেশনকে দিতে হয়েছে ১০ লাখ টাকা। আর দুই শাটার দোকানের জন্য ১৫ লাখ টাকা।

নগর ভবন সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকার নগর প্লাজা, সিটি প্লাজা ও জাকের প্লাজা এই তিন মার্কেটের প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দামে ১ লাখ ৩৬ হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। রাজস্ব বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে হাত করে অবৈধভাবে এসব বরাদ্দ নেন দেলু। এই তিন মার্কেটে জায়গা বরাদ্দের নামে পুরোটাই দখল করেন তিনি। তার পছন্দসই লোকজন দিয়ে মার্কেট তিনটিতে সমিতিও করেন।

গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে দেলোয়ার হোসেন দেলুর আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মার্কেটগুলোয় দেলোয়ার হোসেন দেলুর নিয়ন্ত্রণে ভাটা পড়তে থাকে। ক্যাসিনোকা-ে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার এড়াতে দেলু মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান। পরে গোপনে দেশে ফেরেন। কিন্তু মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ আর ধরে রাখতে পারেননি। অবাক করা হলেও সত্য, এই তিনটি মার্কেটে আলাদা আলাদা সাধারণ সম্পাদক থাকলেও সভাপতি একজনই দেলোয়ার হোসেন দেলু। মার্কেটের দোকান বিক্রি করে দিলেও অদ্ভুত এক নিয়ম করে সব দোকানের কর্তৃত্ব রাখা হয়েছে দেলুর হাতে। সিটি করপোরেশন মালিক হলেও এসব দোকান বিক্রি, ব্যাংক লোনসহ সব কার্যক্রমে স্বাক্ষর নিতে হতো দেলুর থেকে। এসব কাজের জন্যও দিতে হয় আলাদা আলাদা অর্থ।

বরাদ্দ পাওয়া স্থানে দোকান নির্মাণ ছাড়াও নকশার বাইরে গিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলেন নয় শতাধিক দোকান। বাথরুম, বাথরুমের সামনের খোলা জায়গা, লিফটের জায়গা, ফ্লোর স্পেস, বারান্দা, বেজমেন্ট, ক্রেতাদের হাঁটাচলার জন্য রাখা খোলা জায়গা দখল করে এসব দোকান বানানো হয়। প্রতিটি দোকান ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি করেন।

কেবল দোকান বিক্রিই নয়, বিভিন্ন সময় এসব দোকান মালিকদের কাছ থেকে নানা ছুতোয় আদায় করেন লাখ লাখ টাকা। গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে এমন দাবি করে প্রতিটি দোকান থেকে শাটারভেদে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা আদায় করেন দেলোয়ার হোসেন দেলু। পরবর্তী সময়ে এ টাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ ও দেলুর মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।

ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, জুলাই ২০১২ থেকে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত এই তিন মার্কেটের অস্থায়ী দোকান থেকে ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২৯০ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মূলত ২০০৯ সালে নকশাবহির্ভূত দোকানগুলো অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। পরে এসব বাতিল করে ২০১২ সাল থেকে রাজস্ব বিভাগ থেকে এসব বরাদ্দ কার্যক্রম শুরু হয়।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, নতুন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান এবং এর বর্তমান পরিস্থিতি জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি এই মার্কেটে নকশাবহির্ভূত ৯১১টি দোকান চিহ্নিত করে উচ্ছেদের সুপারিশ করেন। এর মধ্যে সিটি প্লাজায় ৩০৮টি, নগর প্লাজায় ২৯২টি ও জাকের প্লাজায় ৩১১টি অবৈধ দোকান রয়েছে।

কমিটির সুপারিশে মেয়র সম্মতি দিয়ে নকশাবহির্ভূত এসব দোকান উচ্ছেদের নির্দেশনা দেন। এসব দোকান উচ্ছেদে আইনি কোনো জটিলতা আছে কিনা তা অনুসন্ধানও করা হয়েছে। করপোরেশনের আইন শাখা জানিয়েছে, নকশাবহির্ভূত এসব দোকান উচ্ছেদে আইনি কোনো বাধা নেই।

করপোরেশনের আওতাধীন সম্পত্তি ও ভবনের দেখভাল করেন সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ। ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন আমাদের সময়কে বলেন, নকশাবহির্ভূত এসব দোকানের মধ্যে কিছু সাময়িক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বরাদ্দের শর্তে উল্লেখ করা হয়েছিল, করপোরেশন চাইলে যে কোনো সময় এসব দোকান উচ্ছেদ করতে পারবে। তবে বরাদ্দ ছাড়াও ফুটপাতে এবং মানুষের হাঁটার জায়গায় অনেক দোকান গড়ে উঠেছে। তাই মেয়রের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা দোকান উচ্ছেদ করব।