কর্মমুখর জনপদ হচ্ছে ভাসানচর

‘আরার দেশ বর্মী। আরার মাতৃভাষা বর্মী। এই স্কুলে আরা বর্মী আর ইংরেজি ভাষা শিকি। আরার বালো লাগে। এইখানে সব আছে। ফড়া, খেলা, আরো কত কিছু যে শিকায়। সকাল সকাল আসি। স্যাররা খুব বালো’ ৯ বছরের রোহিঙ্গা শিশু এভাবেই তার আনন্দ প্রকাশ করল। সকাল ৯টার আগেই সায়েমারা পড়তে চলে আসে। প্রতি ক্লাসে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী ক্লাস করে। এখানে তাদের ইংরেজি ও মিয়ানমারের ভাষা শেখানো হয়।
গতকাল বুধবার ভাসানচরের ২৪ নম্বর ক্লাস্টারে গিয়ে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা শিশুরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ৩০ জানুয়ারি থেকে তাদের ক্লাস চলছে। শিশুরা শিক্ষকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইংরেজি ও মিয়ানমারের বর্ণমালা পড়ছে। ভাসানচর ২৪ নম্বর ক্লাস্টারে বেসরকারি সংস্থা একল্যাব পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। সেখানে দুই শিফটে ছয়টি ক্লাসে শিশু শ্রেণির ক্লাস চলছে।
স্কুলশিক্ষক মুহম্মদ রহিমুল্লাহ বলেন, স্কুলে শিশুদের বার্মিজ, ইংলিশ, অঙ্ক, লাইভ ডেভেলপমেন্ট স্কিল শেখানো হয়ে থাকে। প্রতিদিন দুই শিফটে ক্লাস হয়ে থাকে। প্রথম শিফট সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় শিফট দুপুর ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত। শিশুদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া হয় না। কাগজ-কলমও ফ্রি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
স্কুল ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভাসানচরে স্কুলের খুব চাহিদা রয়েছে। আমরা স্কুলটি গত ৩০ জানুয়ারি চালু করেছি। প্রতি ক্লাসে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী রয়েছে। শিশুদের জন্য লেভেল-১ শ্রেণিতে ছয়টি ক্লাসে ১৮০ জন শিশু পড়ছে। তবে চাহিদা থাকার জন্য নির্ধারিত শিক্ষার্থীদের বাইরেও কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে পড়তে আসে। আমরা তাদেরও পড়াই।
ভাসানচরের প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, সারা দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও ভাসানচরে আমরা স্কুল খোলা রেখেছি। রোহিঙ্গা শিশু ও অভিভাবকদের কল্যাণের জন্যই আমরা স্কুল খোলা রেখেছি। ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে শিশুদের জন্য দুটি স্কুল রয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে মোটিভেশনাল কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ শুরু করেছে বিআরডিবি। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) এবং দেশীয় ৪৩টি স্থানীয় এনজিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
মিয়ানমারে ২০১৭ সালের আগস্টে নিরাপত্তা অভিযানকালে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা দমন-পীড়নের শিকার হন। ওই সময়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
কক্সবাজারে ঘনবসতির কারণে সরকার রোহিঙ্গাদের নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেয়। এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে পর্যায়ক্রমে ভাসানচরে আসবে।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিবিরে দাঁড়িয়ে বিআরডিবির যুগ্ম পরিচালক সুকুমার চন্দ্র দাস বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৭৫০ জন রোহিঙ্গাকে কর্মমুখী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ, কৃষি, শাকসবজি উৎপাদন, কুটিরশিল্প, গবাদি পশুপালন প্রভৃতি। তিনি আরও বলেন, এসব প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর রোহিঙ্গাদের উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন।
কে-ক্রাফটের পরিচালক খালিদ মাহমুদ খান জানিয়েছেন, তারা ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাদের কাটিং, প্যাটার্ন, সেলাই, প্রিন্টিং, স্ক্রিন প্রিন্টিং, ডিজাইন, রং মেশানো, ব্লক প্রিন্টিং, মেশিন এমব্রডারি প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ভাসানচর প্রকল্পের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের কাজের মধ্যে রাখতে হবে। তারা ভাসানচরে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে সরকার ও রোহিঙ্গারা নিজেরা লাভবান হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কাজ করার আগ্রহ প্রবল। তারা ভাসানচরে গবাদি পশুপালন করতে পারবে।