নকলায় শিশুর কাঁধে অবর্ননীয় গুরু দায়িত্ব

শেরপুরের নকলা পৌরশহরের কাঁচা বাজারের পূর্ব রাস্তার দক্ষিণ মাথায় খোলা আকাশের নিচে কিছু শাক-সবজি নিয়ে বসে আছে ৮ বছরের শিশু সাবীব, তার পাশেই বসে আছে সাবীবের সহোদর ভাই ৩ বছরের সাজিদ নামের আরো এক শিশু। তারা স্থানীয় শাক-সবজি ব্যবসায়ী শাখাওয়াত হোসেন ফারুক-এর সন্তান।
রোববার রাত ৮টার দিকে সবজির দোকানটিতে প্রাপ্ত বয়স্ক কেউ না থাকায় স্বাভাবিক কারনেই ক্রেতারা তাদের দোকানে কেনাকাটার জন্য যাচ্ছেননা। রাতেও শিশু দুইটি কেন সবজির দোকানে? সেদিকেও যেন কারো খেয়াল নেই। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষার পরে বাজারের ব্যাগ হাতে মধ্যবয়সী এক ক্রেতা তাদের দোকানের সামনে আসলেন। ক্রেতা হয়তোবা সবজি বিক্রেতা শাখাওয়াত হোসেন ফারুকের পরিচিত কেউ হবেন, অথবা নিয়মিত ক্রেতাদের মধ্যে একজন। তিনি এসে শিশুদেরকে আদরের সুরে স্বাভাবিক ভাবেই জিগাইলেন তোমরা পড়ালেখা বাদ দিয়ে এতো রাতে দোকানে কেন? তোমাদের বাবা কোথায়? এই প্রশ্ন শুনেই ছোট অবুঝ শিশু সাজিদ উচ্চস্বরে জবাব দেয় ‘আব্বা শেরপুর গেছে।’ কিন্তু ৮ বছর বয়সী শিশু তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাবীব কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আব্বাকে গত রাতে পুলিশে ধইরা নিছে। আজকে শেরপুর জেল খানায় নিয়া গেছেগা।’ তাই আম্মা আমাদেরকে দোকানে পাঠাইছেন। কিছু বেঁচলে তা দিয়ে বাজার করবো; এছাড়া দোকানের শাক-সবজি না বেঁচলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
তাদের জবাবের ধরন শুনে অনেকে বিষয়টি কিছুটা বিস্ময়ে, আবার অনেকে জানার আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন। কিছুক্ষণ পরে লোকজন কমলে তারা দুই ভাই আলাপে মেতে উঠে। বয়সের তুলনায় তাদের আলোচনার ভারটা ছিল অবাক করার মতই। দুই শিশুর এমন বাস্তবাদী কঠিন আলোচনা শুনে অনেকটা আগ্রহ নিয়েই তাদের সাথে আলাপে সামিল হলাম।
সাবীব জানায়, তাদের সংসারে মা, বাবা ও দুই ভাই আছেন। পরিবারের আয়ের একমাত্র মাধ্যম শাক-সবজি বিক্রির ছোট্ট এই দোকান। দোকানটি পরিচালনা করেন শাখাওয়াত হোসেন ফারুক নিজে। সংসারের সব খরচ এই দোকান থেকেই জোগাড় করতে হয়। কিন্তুগত বছরের ১২ ডিসেম্বর তারিখে ১৯৭৪ ধারায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৫(৩) মোতাবেক নকলা থানায় একটি মামলা করা হয়; যার নং ৬। ওই মামলায় অজ্ঞাত অযুহাতে সন্দেহজনক হিসেবে শনিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে দোকান বন্ধ করার সময় ফারুককে থানার পুলিশ থানায় ডেকে নিয়ে প্রথমে গ্রেফতার দেখিয়ে রোববার দুপুরের দিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
সহজ সরল নিরিহ প্রকৃতির লোক সবজি ব্যবসায়ী শাখাওয়াত হোসেন ফারুককে গ্রেফতার পূর্বক কারাগারে প্রেরনের পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা, প্রতিবাদসহ দ্রুত স্বসম্মানে কারামুক্তির দাবী জানিয়েছেন অনেকে। প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের এহেন কর্মকান্ড নিয়েও নানান প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
সায়েম ইসলাম নামে একজন তার টাইম লাইনে লেখেন, ছোট একটা ব্যাবসার আয় দিয়ে টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে কোনরকম জীবন কাটছে উনার। অহেতুক বানোয়াট মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে জুলুম করে আজ তাকে জেলে দেওয়া হচ্ছে। উনি কখনও ভিন্ন দলীয় নেতাকর্মী বা সাধারন মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করেনি। অত্যন্ত সহজ সরল সদাহাস্যোজ্জ¦ল অসহায় প্রকৃতির একজন মানুষ। সে দিন আনে দিন খায়, পুরো পরিবার যার উপর চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে। আজকে তারে বিনা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো। ধিক্কার জনাই এমন প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরনকে। যারা পুকুর চুরি করে চোখের সামনে কত বড় বড় রাবুক বোয়ালদের দেখতেছিস যারা গত প্রায় ১৭টি বছর লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় করেছে, তাদেরকে ধরার নাম নাই। সাধারণ জনগনকে হয়রানি করতে মাঠে নেমেছে মেরুদন্ডহীন পুলিশ বিভাগ। এমন একজনকে আজকে কারাগারে প্রেরণ করা হলো সেতো আলু পিয়াজ বেইচ্চা কোনোরকম দিনাতিপাত করেন। এমন লোকদের উপর জুলুম অত্যাচার হয়রানি করলে আল্লাহ সহ্য করবেন না। আওয়ামী লীগের আচরন ও তাদের পলায়ন থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিলো। সাধু সাবধান হয়ে যাও। আল্লাহ সবই জানেন, বুঝেন। তিনিই এসবের উত্তম বদলা দিবেন; ইনশাআল্লাহ।
মোশারফ নামে একজন লেখেন, সংসারে একমাত্র আয়ের মাধ্যম খোলা আকাশের নিচে শাক সবজি বিক্রি করার ছোট্ট একটি দোকান। সহজ সরল দোকানদার ভাইটিকে আজ কারাগারে প্রেরণ করায় অবুঝ দুই শিশুর কাঁধে সংসার পরিচালনার দায়িত্ব! মানবিকতা কতদূর? আল্লাহ সকলকে হেফাজত করুন, বুঝদান করুন। প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর কেন?
আব্দুল্লাহ আল-আমিন লেখেন, বাবা জেলে! তার অনুপস্থিতিতে দোকান সামলাচ্ছে অবুঝ দুই ছেলে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। ধৈর্য ধারন করুন। আল্লাহ উত্তম ফয়সালাদানকারী।
বেশ কয়েকজন পোস্টে বা মন্তব্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কেউ বিভিন্ন কারনে কোন একটি দলকে ভালোবাসতেই পারে। রাজনীতি করলেই তাকে শত্রু বা প্রতিপক্ষ মনে করতে হবে কেন? দেশে যদি একটি মাত্র দলের কর্মী সমর্থক থাকেন, তাহলেতো নির্বাচনের দরকার হতো না। পলাতক সরকারের ঐতিহাসিত পতন থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত। নতুবা তাদের পথেই হাটতে হতে পারে।
নূর হোসেন নামে একজন মানবিক আবেদন জানিয়ে লেখন, নকলা বাজারে যারাই কাঁচা বাজার বা সবজি কিনতে যাবেন, ছবির এই বাচ্চাদের কাছে ক্রয় করে তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারেন।
অনেকে বলেন, ‘অপরধীকে তার প্রাপ্যতা অনুযায়ী শাস্তি দিলে জনগণ খুশি হয় এবং খুশি হবেন। তাদেরকে খোঁজে বের করে প্রয়োজনে জনসম্মূখে শাস্তি দিলেও কেউ বিরক্ত হবেন না। কিন্তু নিরাপরাধ নিরিহ জনগনকে হয়রানি করলে আল্লাহ তথা প্রকৃতি মাফ করবে না। প্রকৃতি সব কিছুর পাই পাই করে হিসেবে করে প্রাপ্যতা অনুযায়ী ফলাফল বুঝিয়ে দেয়।’
তাই শান্তি প্রিয় সাধারণ জনগণের উপর জুলুম অত্যাচার হয়রানি করা থেকে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের প্রতি অনুরোধ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি কামনা করছেন সবপেশা শ্রেণীর জনগণ। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক মহলে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা। বাড়বে সৌহার্দ্যতা। পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ, দেশ ও জাতির মধ্যে বিরাজ করবে সুখ-শান্তি। রাজনৈতিক জগতে বিশ্ব দরবারে আমরা পরিচিতি পাব স্থিতিশীল রাজনীতির মডেল জাতি হিসেবে।