চট্টগ্রাম বন্দর: রাত থেকে এনসিটি পরিচালনায় ড্রাইডক

চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল নিউমুরিং আগামী ছয়মাস পরিচালনার জন্য দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে নৌবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড।
গতকাল রোববার মধ্যরাত থেকে তারা (ড্রাইডক) নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ভার বুঝে নিয়েছে বলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্তও দায়িত্ব পালন করে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি বা ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম) এ কাজ পেয়েছে চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড।
দীর্ঘদিন ধরে এনসিটি পরিচালনা করে আসছিল বেসরকারি অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। রোববার প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেসরকারি অপারেটরটির সাথে চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন না।
তারা বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কন্টেইনার টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগের কথা জানায়। আর সেই কাজে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম উঠে আসে। কিন্তু অন্তবর্তী সময়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এনসিটি পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
পরে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন এনসিটি পরিচালনার দায়িত্বভার নৌবাহিনীকে দেওয়ার কথা জানান।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “এনসিটি পরিচালনায় সাইফ পাওয়ার আর থাকছে না। তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রোববার মধ্যরাত থেকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব ড্রাইডক বুঝে নিয়েছে। নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় তারা এটি পরিচালনা করবে।”
তিনি বলেন, “আগের অপারেটরের সাথে যেসকল শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করত, তারাই এনসিটি পরিচালনার সাথে থাকছে। টার্মিনালটি আগে যেভাবে চলত, সেভাবেই পরিচালিত হবে। শুধু ব্যবস্থাপনার বদল হয়েছে।”
শিগগিরই কার্যাদেশের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলা হবে জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, “অপারেশনাল কার্যক্রম সব আগের মতই চলবে। শিগগিরই এ চুক্তি করা হবে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কন্টেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এনসিটি। এই টার্মিনালের পাঁচটি জেটির মধ্যে চারটিতে কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ এবং অন্য জেটিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী ছোট জাহাজ ভেড়ানো হয়।
বন্দরে যত কন্টেইনার ওঠা-নামা করে, তার বেশিরভাগই হয় এনসিটিতে। ২০২৪ সালে মোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ হয়েছে এই টার্মিনালে।
বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এনসিটির পাঁচটি জেটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ কাজে বন্দরের খরচ হয়েছিল ৪৬৯ কোটি টাকা।
এর দুই বছর পর এনসিটির জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে বিনিয়োগ করার শর্তে পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছিল। তখন বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আগ্রহী ছিল। পরে সেই দরপত্র বাতিল করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তারপর টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য ২০১২ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর দরপত্র সংশোধনের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে পরবর্তীতে মামলা হলে টার্মিনাল পরিচালনা ঝুলে যায়। নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৫ সালের ২৫ জুন এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ার টেক এবং এর দুই অংশীদার প্রতিষ্ঠান।
একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর এনসিটির ২ ও ৩ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এনসিটি পরিচালনার ওই দায়িত্ব পেয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর এনসিটিতে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
পরবর্তীতে এনসিটি পরিচালনায় আর দরপত্র ডাকা হয়নি। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) প্রতিবার ছয় মাসের জন্য এনসিটির টার্মিনালগুলো পরিচালনা করে আসছিল সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। টানা একাদশবার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। এরপর দ্বাদশতম বারের মত আরও ছয় মাসের জন্য তাদের এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুরু থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনায় কী-গ্যান্ট্রি ক্রেইন ও রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেইনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ খরচ করেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এনসিটিতে বছরে ১০ লাখ একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা আছে। ২০২৪ সালে দেশি বেসরকারি অপারেটর এনসিটিতে ১২ লাখ ৮১ হাজার একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরের কাছে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখনই এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম আলোচনায় আসে। গত বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের মত অর্ন্তবর্তী সরকারও এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগে আগ্রহের কথা জানায়। এবারও আলোচনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অবস্থান জানানোর পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন সংগঠন এনসিটি বিদেশিদের দেওয়ার বিরোধিতা করে আন্দোলনও শুরু করে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ড্রাইডক লিমিটেড প্রাথমিকভাবে ছয়মাসের জন্য অথবা পরবর্তীতে নতুন অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনা করবে।