ইউরোপে চাকরির কথা বলে ভারতে পাচার

চাকরির ভিসায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মানব পাচারকারী চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা। ভুয়া ভিসায় প্রথমে ভারত, পরে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায় করে চক্রটি। এরপর তাদের বিভিন্ন জঙ্গলে ফেলে রাখা হয়। সম্প্রতি কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেয়ে মানব পাচারকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিআইডির সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।
ওমর ফারুক জানান, গ্রেপ্তার মানব পাচারকারী হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ, জামাল হোসেন ও নাহিদুল ইসলাম পলাশের থেকে ২৮টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দূতাবাস, ব্যাংক ও এজেন্সির ১৯টি সিলমোহর এবং কম্বোডিয়ার ১০টি জাল ভিসা উদ্ধার করা হয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে (মাল্টা, চেকপ্রজাতন্ত্র ও হাঙ্গেরি) পাঠানোর কথা বলে টাকা নিত। পরে তারা অনুমোদনহীন এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অনুমোদনহীনভাবে প্রথমে ভিজিট ভিসায় ল্যান্ড চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে পাঠাত। সেখানে নেওয়ার পর ভুয়া ভিসা দিয়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে নানাভাবে টাকা নিত। যাদের পরিবার টাকা দিত না তাদের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করত এবং টাকা আদায় শেষে জঙ্গলে ছেড়ে দিত। এই সংঘবদ্ধ চক্রে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের দালাল চক্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়াও এই সংঘবদ্ধ চক্রটি ইউরোপে নেওয়ার কথা বলে জাল ভিসা সরবরাহ করত।
অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘তারা প্রথমে লোক সংগ্রহ করার পর ঢাকা থেকে বিআরটিসি বাসে করে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছে দিত। এরপর তাদের অন্য দালালের হাতে তুলে দিত। সেখানকার দালাল তাদের কৌশলে কলকাতা পাঠাত। দালালের মাধ্যমে তাদের পরে পাঠানো হতো হায়দরাবাদ। সেখানকার দালালরা বিদেশ গমনেচ্ছুদের মারধর করে টাকা আদায় করত। পরে তাদের ট্রলার বা নৌকায় করে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো বিভিন্ন দেশের গহিন জঙ্গলে ফেলে রেখে আসত। ওইসব জঙ্গল থেকে কেউ কেউ কৌশলে পালিয়ে এলেও অনেকেই তাদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকত। এভাবে তাদের কাছ থেকে আরও টাকা আদায় করত চক্রটি। সম্প্রতি প্রায় ২৭ জনকে নিয়ে যাওয়ার পর কৌশলে শ্রীলঙ্কার জঙ্গল থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে চারজন। তারা এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘটনাটি জানায়। সে ঘটনার সূত্র ধরে আমরা চারজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এদের সঙ্গে আরও দুজন জড়িত রয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, ‘চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। কারণ যারা পালিয়ে এসেছে তারা বলেছে, ‘যেসব স্থানে গেছে সেসব স্থানে স্থানীয়দের এ কাজে জড়িত থাকতে দেখেছে।’ তাই আমরা আরও বিশদ তদন্ত শেষে সেসব দেশের সঙ্গে (ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) যোগাযোগ করে তাদেরও আইনের আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করব।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার হাতুড়াবাড়ি গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, ‘মাল্টা পাঠানোর কথা বলে ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয় চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়ই ৮ লাখ টাকা দিই। বলেছিল, চাকরিতে জয়েন করার পর বাকি টাকা নেবে। কিন্তু ভারতের হায়দারাবাদে নিয়ে নির্যাতন করে বাকি চার লাখ টাকা আদায় করে আমাকেসহ আরও প্রায় ২৬ জনকে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফেলে দেয়। আমিসহ চারজন সেখানকার স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাড়িতে ফোন করে ৩৩ হাজার টাকা এনে দেশে ফিরি।’
এ প্রসঙ্গে ওমর ফারুক বলেন, ‘বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছিচক্রটি এ কাজে ছয় থেকে সাত বছর ধরে জড়িত। তারা ১০০ জনের মতো লোক পাচার করেছে। কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত সেসব ভিকটিমদের সন্ধান পাইনি। সেসব বিষয়ে আমাদের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।’