ঢাকা সোমবার, ১২ই মে ২০২৫, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩২


স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্ধারণ হয়নি রাজধানীর আয়তন


১১ জানুয়ারী ২০২১ ০৭:০৪

আপডেট:
১১ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৪১

ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এ কথা সবারই জানা। তবে এ রাজধানী ঢাকার আয়তন কতটুকু? এর সীমানাই বা কোনটা, তা স্পষ্ট নয়। কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আদমশুমারি বলছে, ঢাকার আয়তন এক হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটার। আবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধিভুক্ত ঢাকার আয়তন আবার এক হাজার ৬৮৩ দশমিক পাঁচ বর্গকিলোমিটার।

যদিও ঢাকা বলতে অনেকেই বোঝেন দুই সিটি করপোরেশনের সম্মিলিত আয়তন, বর্তমানে যা দাঁড়িয়েছে ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। আবার মেট্রোপলিটন হিসাবে ঢাকার আয়তন ধরা হয় এক হাজার ৫৬০ বর্গকিলোমিটার। তবে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) হিসাবে ঢাকার আয়তন আরও বড়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার।

তথ্যমতে, ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে সংবিধানের মাধ্যমে। আর রাজধানীর আয়তন কতটুকু হবে, এর সীমানাই বা কতটা, তা নিয়ে যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সংবিধানেই এ ব্যাপারে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে।

সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’ তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন হয়নি। এমনকি গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমেও ঢাকার আয়তন বা সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে একেক সংস্থা একেকভাবে এর সীমানা ধরে নিচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে রাজধানীকে নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন।

সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ, ঢাকার চেয়ারম্যান ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চললেও এখনও নির্ধারণ করা হয়নি রাজধানী ঢাকার আয়তন। ঢাকার কতটুকু আসলে রাজধানী, তার উত্তর কারও জানা নেই। সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও এ-সংক্রান্ত কোনো আইন করা হয়নি। কোনো গেজেট প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও কার্যত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতিবার আদমশুমারিতে রাজধানী ঢাকার আয়তন বেড়েছে। স্বাধীনতার আগে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার আয়তন ছিল খুবই ছোট, মাত্র ২৮ বর্গমাইল (৭২ দশমিক ৫২ বর্গকিলোমিটার)। ১৯৬১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটারে। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ঢাকার সীমানা দাঁড়ায় ১০৩ দশমিক ছয় বর্গকিলোমিটার। সে সময় ঢাকা বলতে শুধু ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন এলাকাকেই বিবেচনা করা হতো।

১৯৮১ সালে ঢাকার আয়তনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। সে বছর আদমশুমারির সময় স্ট্যাটিসটিক্যাল মেট্রোপলিটন এলাকা ধারণার সূত্রপাত করে বিবিএস। এতে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ছাড়াও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, টঙ্গী পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বেরাইদ, সাতারকুল, ডেমরা,

শ্যামপুর, মাতুয়াইল, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজী নগর, ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, আমিনবাজার, সাভার ও তৎসংলগ্ন এলাকা ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

স্ট্যাটিসটিক্যাল মেট্রোপলিটন এলাকা হিসেবে ঢাকার আয়তন দাঁড়ায় এক হাজার ১২০ দশমিক আট বর্গকিলোমিটার। আর ২০১১ সালের বিবিএসের সর্বশেষ আদমশুমারি হিসাবে ঢাকার আয়তন আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটারে। ২০২১ সালের শুমারিতে তা আরও বড় হতে পারেই বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে রাজউকের হিসাবেও ঢাকার আয়তন বেড়েছে। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন ডিআইটি (ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) প্রণীত স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে ঢাকার আয়তন ধরা হয় ২৪০ বর্গমাইল বা ৬২১ দশমিক ছয় বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৭ সালে ডিআইটিকে রাজউকে রূপান্তর করা হয়। তখন রাজউকের অধিভুক্ত ঢাকার আয়তন দাঁড়ায় ৬৫০ বর্গমাইল বা এক হাজার ৬৮৩ দশমিক পাঁচ বর্গকিলোমিটার। এ সময় মিরপুর, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

যদিও সিটি করপোরেশনের হিসাবে ঢাকার আয়তন মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার, তবে ২০১৬ সালে সর্বশেষ জারি করা গেজেটে তা উল্লেখ আছে ২৬৯ বর্গকিলোমিটার। আর ডিটিসিএর হিসেবে ঢাকার আয়তন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার, যা সাবেক বৃহত্তর ঢাকা জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল।

বিশেষজ্ঞরা জানান, রাজধানী ঢাকার আয়তন নির্দিষ্ট না হওয়ায় এর জনসংখ্যা কত বা জনসংখ্যার ঘনত্ব কত, তাও নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ফলে রাজধানী নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকা বিবেচনা করলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ঢাকায় ৪১ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। আর রাজউকের ঢাকা হিসাব করলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস করে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের আয়তন বিবেচনায় ঢাকার সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর রাজউকের আয়তন ধরলে তা দাঁড়াবে এক কোটি ৭৫ লাখ। তবে ডিটিসিএ’র আয়তন বিবেচনায় ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি। সুতরাং বিষয়টি খুবই জটিল।

জানা গেছে, রাজধানী ও আশপাশের জেলার যানজট নিরসনে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয় কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ডিটিসিএ। আর ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১০ সালে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করে রাজউক। এ দুই মহাপরিকল্পনায় ঢাকার আয়তন নিয়েও রয়েছে জটিলতা। ফলে ড্যাপ ও এসটিপির মধ্যে সমন্বয় করা যায়নি। এমনকি বর্তমানে দুই মহাপরিকল্পনা সংশোধনের কাজ চললেও এগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা যাচ্ছে না।

ড্যাপের ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ, গাজীপুরের কিছু অংশ ও সাভার। আর এসটিপিতে ঢাকা বলতে পাঁচটি জেলাকে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হলোÑঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ। এর সঙ্গে নরসিংদীর আংশিকও ঢাকার অন্তর্ভুক্ত। পুরো এলাকা বৃহত্তর ঢাকা জেলা হিসেবে এসটিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের অংশটুকু রাজধানী ধরলে ঢাকা খুবই ছোট। তবে রাজউকের সীমানা ধরলে সাভার উপজেলা হয়েও যেমন ঢাকার ভেতর এসে যায়, তেমনি পৃথক জেলা হওয়ার পরও রাজধানীর অংশ হয়ে যায় গাজীপুর।

তিনি আরও বলেন, ঢাকায় চাকরির জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় বেতন দেয়া হয় বেশি। আবার ঢাকায় করের পরিমাণও বেশি। অথচ ঢাকার নির্ধারিত কোনো আয়তন নেই। তবে এ বিষয়টি নিয়ে কখনও কেউ চিন্তাও করেনি। তাই প্রকৃতপক্ষে রাজধানীর আয়তন কতটুকু তা চিহ্নিত করা উচিত।শেয়ার বিজ