ঢাকা সোমবার, ১২ই মে ২০২৫, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩২


উত্তরা ফাইনান্সের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম!


১৪ জানুয়ারী ২০২১ ২২:০৩

আপডেট:
১২ মে ২০২৫ ২২:০২

দেশের নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুই তৃতীয়াংশই নানা অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতিতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও আর্থিক খাতের ওপর করা গবেষণায় সে তথ্য পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়। তবে বরাবর একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তির ভালো প্রতিষ্ঠানের তালিকায় দেখা গেছে উত্তরা ফাইনান্সকে। এবার সে প্রতিষ্ঠানেরই আর্থিক অনিয়মের ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে। এ অনিয়ম টাকার অংকে পিকে হালদার কাহিনীর বহুল সমালোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংকেও ছাড়িয়েছে উত্তরা ফাইনান্স, যা ৫ হাজার কোটিরও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব অনিয়ম পেয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে তার মধ্যে আছে, মার্চেন্ট ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজারের মার্জিন ঋণের ৫৯৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা জমা হয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্সের বিভিন্ন পরিচালকের ব্যাংক হিসাবে। যেখানে কোনো ধরনের আবেদন, প্রস্তাব বা অনুমোদন ছাড়াই পরিচালকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি এ টাকা ছাড় করা হয়েছে।

এতে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে আরও ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৩১১ কোটি টাকা। বাকি টাকার কোনো তথ্যই নেই।

২০১৯ সালের হিসাব শেষে অগ্রিম ও আগে পরিশোধ হিসাবে ঋণের স্থিতি ছিল ৭৯৯ কোটি টাকা। তবে কাদের এ অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া উত্তরা ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান রাশেদুল হাসান পাওনার বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসবের বাইরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা উত্তরা ফাইন্যান্স পরিদর্শনে পেয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের এমডি এস এম শামসুল আরেফিন কোনোরকম অনুমোদন ছাড়াই ব্যবস্থাপনা ব্যয় শিরোনামে ২৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। যার মধ্যে এমডির পক্ষে সাউথ ব্রিজ হাউজিংকে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, বে ডেভেলপমেন্টকে ১ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে ডিএইচএসকে ৫০ লাখ টাকা ও উত্তরা মটরসকে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এমডির এসব টাকা উত্তোলনে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না। এর বাইরে উত্তরা মটরস ও উত্তরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩৩৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, তারও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকার অপব্যবহার পাওয়া গেছে।

আর এসব অনিয়ম ঢাকতে উত্তরা ফাইন্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যে ব্যাখ্যা পাঠিয়েছে, তা হলো আর্থিক সংকটে পড়ে তারল্য-সংকট মেটাতে উত্তরা গ্রুপ থেকে কিছু টাকা ধার করতে হয়েছিল। পরে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। এছাড়া এমডি তার অসুস্থ ছেলের চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে টাকা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উত্তরা ফাইনান্সের পরিচালক মুজিবুর রহমান, ব্লু চিপস সিকিউরিটিজের কর্ণধার। যে প্রতিষ্ঠানের ২৩৬ কোটি টাকা আমানত জমা করা হয়েছে উত্তরায়। তবে এর বিপরীতে কোনো বৈধ নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়নি। টাকা জমার বিষয়টি নিশ্চিত নয়। এ অবস্থায় কোনো ব্যাংক এ আমানতের বিপরীতে ঋণ দিলে পুরো দায় পড়বে উত্তরা ফাইন্যান্সের ওপর।

উত্তরা ফাইন্যান্স পরিদর্শন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, লেনদেনের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে উত্তরা ফাইন্যান্স আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

উত্তরা ফাইন্যান্সের এমডি এসএম শামসুল আরেফিন গণমাধ্যমে বলেন, আমাদের সিএফওর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে কিছু নথিপত্র খুঁজে পেতে ও দীর্ঘদিনের পুরোনো হিসাব তাৎক্ষণিকভাবে মেলাতে পারিনি। এখন আমরা বেশির ভাগ নথি খুঁজে বের করেছি। সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাও দিয়েছি। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি।

উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছিল এসএফ আহমেদ অ্যান্ড কোং। তাদের কোনো ধরনের আপত্তি না তোলাটা কতটা স্বাভাবিক এমন প্রশ্নের জবাবে সনদধারী হিসাববিদ বা নিরীক্ষকদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সহ- সভাপতি সাব্বির আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, উত্তরা ফাইন্যান্সে যা ঘটেছে, এখানে হয়তো নিরীক্ষকদের মিসগাইড করা হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি হয়তো দুই হিসাব তৈরি করেছে, একটা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য আরেকটা নিজেদের জন্য। এভাবে মাস্কিং করা হলে অল্প সময়ের সাধারণ নিরীক্ষায় অনিয়ম ধরা কঠিন। কেননা নিরীক্ষকদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও ওপর নির্ভর কিছুটা করতেই হয়। এসব ক্ষেত্রে সন্দেহজনক ঘটনায় ফরেনসিক নিরীক্ষা করতে হয়। যেখানে পুরো প্রতিষ্ঠানের তথ্যের ডাটাবেজ, কম্পিউটার সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যায়।

নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উত্তরা ফাইন্যান্স ১৯৯৫ সালে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় ৩টি, বগুড়া ও চট্টগ্রামে ১টি মোট ৫টি শাখা আছে প্রতিষ্ঠানটির।

এদিকে, অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে প্রচারের পর, মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সকালে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ২ টাকা ৭০ পয়সা কমে ৪৭ টাকায় লেনদেন হয়। পরে দুপুর ১টার দিকে দাম দাঁড়ায় ৪৮ টাকা ৮০ পয়সায়। সোমবার যার সবশেষে দাম ছিল ৪৯ টাকা ৭০ পয়সা।

২০১৯ সালে উত্তরা ফাইন্যান্সে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ৪৫ পয়সা মুনাফা হয়েছে। এর বিপরীতে অভিহিত মূল্য ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারে ১৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যা শেয়ারপ্রতি মুনাফার বিবেচনায় ২১ শতাংশ।

এদিক থেকেও বলা যায়, প্রতিষ্ঠানটি তার শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করেছে। আগের বছর এরচেয়ে কম মুনাফা নিয়েও ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল উত্তরা ফাইনান্স। কোম্পানিটির ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ৪৫ পয়সা হিসাবে মোট ১১৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছে। এরমধ্যে থেকে ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫০ পয়সা করে মোট ১৮ কোটি ৭৮ টাকা বা ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। আর ৫ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকার বা ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বোনাস শেয়ার বিতরণ করা হচ্ছে। এতে ৯৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা বা ৭৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ রিজার্ভে যোগ হবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেট অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি কোনো অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিজার্ভে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি এরূপ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রতিবছর রিজার্ভে সরবরাহ করা অংশের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। যা আগামী বছর থেকে কার্যকর হবে।