যা করতে এসেছিলাম করেছি, যুদ্ধে জড়াইনি

এরই মধ্যে গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সব ছাপিয়ে যেন এখনো আলোচনায় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তার মতো আর কোনো প্রেসিডেন্ট সম্ভবত এত তিক্ততা নিয়ে বিদায় নেননি। দায়িত্ব ছাড়ার আগে তাই ট্রাম্প তার বিদায়ী ভাষণে কী বলেন তা নিয়েও ছিল সবার মধ্যে তুমুল কৌতূহল। অবশেষে গতকাল ইউটিউবে ট্রাম্প তার বিদায়ী ভাষণ পোস্ট করেন। এতে একদিকে যেমন ছিল নিজের শাসনামলের প্রশস্তি, আবার অন্যদিকে ছিল নতুন মার্কিন প্রশাসনের জন্য শুভকামনা। তবে বিদায়বেলাতেও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের নাম উচ্চারণ করেননি তিনি। বরং বাইডেনের নাম না নিয়েই নতুন প্রশাসনের সাফল্যের জন্য দেশবাসীকে প্রার্থনার আর্জি জানান ট্রাম্প।
ভিডিও বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘বুধবার দুপুরে নতুন প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনাদের জানাতে চাই, আমরা যে আন্দোলনের সূচনা করেছি তা মাত্র শুরু হয়েছে। যতদিন আমেরিকান জনগণ হৃদয়ে গভীরভাবে দেশের জন্য ভালোবাসা রাখবে, ততদিন এই জাতি অর্জন করতে পারবে না এমন কিছুই নেই। আমেরিকা ও দেশের মানুষ আরও সমৃদ্ধ হবে। আমাদের ঐতিহ্য লালিত হবে। ভবিষ্যৎ
আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল হবে আমেরিকার।’
৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যা অর্জন করেছেন তা সত্যিই গর্বের ছিল বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘যা করতে এসেছিলাম, তার সবই করেছি। এর বাইরেও আরও অনেক কিছু করেছি। কেউ ভাবেনি আমরা এতটা সফল হব। আমি এ দশকের প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশেষ গর্বিত, যার আমলে দেশ নতুন কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি।’
ট্রাম্পের মেয়াদের শেষ দুই সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে তার সমর্থকদের ভয়ঙ্কর হামলা। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল উল্টে দিতে সেদিন হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটাল হিল ভবনে ঢুকে পড়লে পুলিশের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত এক পুলিশ সদস্যসহ ৫ জন মারা গেছে। বিদায় ভাষণে ট্রাম্প সেই ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ক্যাপিটাল হিলে হামলার ঘটনায় পুরো দেশ আতঙ্কিত হয়েছিল। এ রকম রাজনৈতিক সহিংসতা আমেরিকার মূল্যবোধের ওপর আঘাত। এটি কখনো সহ্য করা যায় না। মনে রাখতে হবে, আমেরিকানদের মধ্যে মতবিরোধ থাকবে তবে তারা বিশ্বস্ত ও শান্তিকামী। নিজেদের দেশকে তারা সমৃদ্ধ দেখতে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা যা যা লালন করি, তার সবকিছুর ওপর আঘাত।’
গত ৩ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার পর থেকে লাগাতারভাবে ডেমোক্রেট শিবিরকে আক্রমণ করে গিয়েছেন রিপাবলিকান ট্রাম্প। জালিয়াতি করে তাকে হারানো হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন, এমনকি করেছেন মামলাও। কিন্তু তাতে কোনো লাভ না হওয়ায় অশান্তি সৃষ্টির জন্য নিজের সমর্থকদের উসকানিও দিয়েছেন বলে বিরোধীদের দাবি। তবে ক্যাপিটাল হিলের ঘটনার পর দ্বিতীয়বার ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হওয়ায় কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। এতটাই নাকি চাপে ছিলেন যে এক সপ্তাহ ধরে জনসমক্ষেও দেখা যায়নি তাকে।
বিবিসি বলেছে, করোনা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত চার লাখ মার্কিনির মৃত্যু আর প্রায় আড়াই কোটি মানুষ আক্রান্ত হলেও সেসব ছাপিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে ক্যাপিটাল হিলের ওই দাঙ্গা। তবে বিদায়ী ভাষণে ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। তিনি বলেন, আমাদের এজেন্ডা ডান বা বামপন্থি, এটা রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্রেটের বিষয় নয়। এটা পুরো জাতির জন্য। আমেরিকান ইতিহাসে কর ছাড় এবং সংস্কারের সবচেয়ে বড় প্যাকেজটি আমরা পাস করেছি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করেছি। সুসংগঠিত করেছি বাণিজ্য চুক্তিগুলো। ভয়াবহ ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব এবং অসম্ভব প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসে একতরফা দক্ষিণ কোরিয়া চুক্তি পুনর্বিবেচনা করেছি। নাফটা চুক্তিকে ইউএসএমসিএর সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে স্থাপন করেছি, যা মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে খুব কার্যকর একটি চুক্তি। এ ছাড়াও এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা চীনের ওপর ঐতিহাসিক শুল্ক আরোপ করেছি। আমরা উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি, হাজার হাজার নতুন কারখানা খুলেছি। সর্বোপরি আবারও প্রতিষ্ঠিত করেছি মেড ইন ইউএসএ ট্যাগকে।
বিবিসি আরও লিখেছে, যখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দপ্তর ছাড়ছেন, তখন তার জনসমর্থনের হার ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা কোনো বিদায়ী প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বনিম্ন হারের একটি রেকর্ড।
এদিকে গতকাল ওয়াশিংটন ডিসি সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ফার্স্টলেডি মেলানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে মেরিন ওয়ান হেলিকপ্টারে করে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন ট্রাম্প। এর আগে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছোট ছোট বাক্সে করে সরিয়ে নেন কর্মকর্তারা। ট্রাম্প ও মেলানিয়াকে নিয়ে মেরিন ওয়ান হেলিকপ্টার উড়ে যায় মেরিল্যান্ডে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটি জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রুতে। সেখানে বিমানবাহিনীর সদস্যরা ট্রাম্প ও ফার্স্টলেডি মেলানিয়াকে গান স্যালুট দেন। পরে এক বিদায় অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছিল আমার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্মান ও সুযোগ। এটি একটি মহান দেশ। আমি সব সময় আপনাদের জন্য লড়াই করব। আমি সব সময় আপনাদের দিকে দৃষ্টি রাখব এবং শুনব। আমি আপনাদের বলব যে, এই দেশ এত ভালো আর কখনো ছিল না। আমি বিশ্বাস করি বাইডেন প্রশাসন দারুণ সফল হবে। খুব দারুণ কিছু করার জন্য তাদের চমৎকার ভিত্তি রয়েছে। বিদায় এবং আমি আপনাদের ভালোবাসি। আমরা অন্যভাবে আবার ফিরে আসব। সবার সুন্দর জীবন কামনা করি। খুব শিগগিরই আবার দেখা হবে।’
ফক্স নিউজের খবর অনুযায়ী, জয়েন্ট বেস অ্যান্ড্রু থেকে ট্রাম্প ও মেলানিয়া একটি বিমানে করে ফ্লোরিডা চলে যান। সেখানে ট্রাম্পের মালিকানাধীন পাম বিচ সংলগ্ন মার-এ-লাগো ক্লাব রিসোর্টে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে এ দম্পতি।