সোনা-মানব পাচার
ফাঁসছেন বিমানবন্দরের ১০৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী!

বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সোনা ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এসব অপরাধের সঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের (বেবিচক) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে তারা সোনা ও মানব পাচারে বেশি সক্রিয়। এসব ঘটনায় জড়িত থাকায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত এক বছরে বেবিচকের ২৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি আইনে মামলাও হয়েছে। তবে জামিনে কারামুক্ত হয়ে তারা ফের একই কারবার চালাচ্ছে বলে তথ্য মিলছে। এ পরিস্থিতিতে অপরাধে জড়িত বেবিচকের ১০৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রোফাইল সংগ্রহ করেছে পুলিশ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকরিরত এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব তথ্য-প্রমাণ হাতে আসামাত্র তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে পুলিশ। ইতিমধ্যে বেবিচকের এসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের সবুজ সংকেত পেয়েছে বলেও জানতে পেরেছে দেশ রূপান্তর।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে আমরাও কাজ করছি। বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওইসব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সবকটি বিমানবন্দরের অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দিব্যি অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে চক্রের সদস্যরা। সোনা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে বেবিচকের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তাছাড়া মানব পাচার, মাদক পাচার ও নাশকতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। আর এসব অভিযোগের কারণে গত এক বছরে ২৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র তিনটি মামলার।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে আসা তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক সোনা চোরাচালানের অন্যতম রুট হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাচারের বাহক ও তাদের আশ্রয়দাতারা মধ্যপাচ্যের কয়েকটি দেশে অবস্থান নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সোনার চোরাচালান। বিভিন্ন সময় ওই পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হলেও আইনের ফাঁকফোকর গলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফের জড়িয়ে পড়ছে তারা। আবার কেউ কেউ জামিনে ছাড়া পেয়ে দেশও ছেড়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের সবকটি বিমানবন্দর দুর্নীতিমুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বেবিচক বা বিমানের কোনো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুর্নীতি এবং অনিয়ম দূর করার চেষ্টা চলছে। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেবিচক ও বিমানসহ বিভিন্ন সংস্থার অপরাধ ঠেকাতে নতুন করে পরিকল্পনা নিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। তারা বেবিচকের অপরাধী সিন্ডিকেটকে ভেঙে দিতে চাচ্ছে। অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকা হয়েছে। তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। এমনকি বিমানবন্দরে তাদের প্রবেশও অনেকটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছিঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে। কারও ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বেবিচকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শাহজালালসহ সবকটি বিমানবন্দরে অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। তাদের পাশাপাশি বিমানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীও রয়েছেন। তাছাড়া বিভিন্ন সংস্থার কিছু সদস্যের নামও পাওয়া গেছে। তারা সোনা ও মানব পাচারে বেশি জড়িত। পাশাপাশি মাদক কারবারেও সক্রিয় থাকার তথ্য এসেছে। আর এসব কারবার চালিয়ে অনেকে ফ্ল্যাট ও জমিজমার মালিক হয়েছেন। আমরা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বেবিচকের ১০৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রোফাইল সংগ্রহ করেছি। তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। অপরাধের তথ্য-প্রমাণ হাতে আসার পরপরই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, শাহজালালে কর্মরত বেবিচকের সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী একেএম আমানুল্লাহ মিয়া, বোর্ডিং ব্রিজ অপারেটর হাফিজুর রহমান আকন্দ (তার কাছ থেকে ৪ কেজি ২শ গ্রাম ওজনের ৬টি সোনার বার উদ্ধার), নিরাপত্তা প্রহরী রেজাউল করিম (সাময়িক বরখাস্ত), নিরাপত্তা প্রহরী মো. আবু তালেব (সাময়িক বরখাস্ত), হেলপার (ই/এম) ইলিয়াস উদ্দিন, এরোড্রাম ফায়ার ফাইটার তাওহীদুল ইসলাম, মেকানিক জামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, নিরাপত্তা প্রহরী মাহবুবুল আলম, এটিএস শাখায় কর্মরত ট্রাফিক হ্যান্ড আকরাম হোসেন, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মোমেন মোকছেদ, ট্রলিম্যান রেজাউল করিম, নিরাপত্তা প্রহরী বেলায়েত হোসেন মোল্লা, রাসেল খান, নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিন, এরোড্রাম ফায়ার লিডার এএসএম সেলিম, নিরাপত্তা সুপারভাইজার আবদুল বারেক শিকদার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাসু মিয়া, সিনিয়র এরোড্রাম অফিসার হাসান জহির, সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) শহিদুল ইসলাম ম-ল, নিরাপত্তা প্রহরী সুমন হোসেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী দুলাল মিয়া, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবু হানিফা, রেডিও টেকনিশিয়ান সবুর খান, হিসাব নিরীক্ষক হাফিজুর রহমান, অফিস সহকারী হাসান পারভেজ, এএসজি সাইফুল ইসলাম, এএসজি কবির, যোগাযোগ সহকারী আসাদুজ্জামান খোকন, অপারেটর দীপক, সিকিউরিটি মনিরুজ্জামান খান, শাহজালাল সরকার, সিকিউরিটি বসর, বোর্ডিং ব্রিজের অপারেটর কবির, এলডিএর (এম্বারোগেশন সি-কালেক্টর) এনামুল, সুপারভাইজার জিন্নাহ, অপারেটর ফজলুর রহমান ওরফে ফজলু, অপারেটর শাহাদাৎ হোসেন, শরীয়তপুরের মিজান, ফায়ার অপারেটর মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, সিকিউরিটি জিল্লুর, ফায়ার অপারেটর মিজানুর রহমান খান, সিকিউরিটি বাবুল চন্দ্র দাস, সিকিউরিটি গাজী তোফায়েল, সিকিউরিটি হাজী আজাদ, সিকিউরিটি তানভীর হোসেন মিয়া, সিকিউরিটি সোহেল রানা, সিকিউরিটি কাজী মাসুদ, এম্বারোগেশন সি-কালেক্টর আবদুল মতিন, সিকিউরিটি ইদ্রিস মোল্লা, সিকিউরিটি শাখাওয়াত হোসেন তুহিন, সিকিউরিটি রফিকুল ইসলাম এবং ফায়ার অপারেটর ফরিদ উদ্দিনসহ ১০৫ জনের বিরুদ্ধে সোনা পাচারসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল অনুসন্ধান করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।