‘চাকরি প্রতারক’ শেরেজামান!

কখনো ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে টাকা আত্মসাৎ, আবার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা বলে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের কম্পিউটার অপারেটর শেরেজামান সম্রাট।
তবে চাকরিপ্রার্থীদের কপালে সেই চাকরি আর জুটত না। ক্যাম্পাস ও এর আশপাশ এলাকাজুড়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ কর্মচারী এখন ‘চাকরি সম্রাট’ নামে পরিচিত। আর শেরেজামান সম্রাটের প্রতারণার কাজে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ এবং মাস্টাররোলের কর্মচারী গুলশান আহমেদ শাওন। তাদের প্রতারণার প্রমাণসংক্রান্ত বিভিন্ন অডিও ও ভিডিও রেকর্ড এবং মোবাইল ফোনে পাঠানো খুদেবার্তা দেশ রূপান্তরের কাছে এসে পৌঁছেছে।
আরো পড়তে,অভিযোগ প্রমাণিত, তবু চাকরিতে বহাল-পদোন্নতি!
জানা গেছে, শেরেজামান সম্রাটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তিন কর্মকর্তা- কর্মচারী বিভিন্ন কৌশলে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরাসরি বা ফোনে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে থাকেন। তারা কখনো নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আবার কখনোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের আস্থা অর্জন করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন। একপর্যায়ে চাকরিপ্রার্থীরা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে টাকা ফেরত চাইলে নিজেরাই মীমাংসার নামে কথিত সালিশ বসান। বিভিন্ন অডিও ও ভিডিও রেকর্ড এবং মোবাইল ফোনে পাঠানো খুদেবার্তায় দেখা গেছে, রংপুরের মিঠাপুকুরের বাসিন্দা মো. রুবেল সাদীকে সেকশন অফিসার-০২ পদে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৬ লাখ টাকার চুক্তি করেন অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সেই চুক্তি অনুযায়ী তিন ধাপে ১৩ লাখ টাকা প্রদান করেন রুবেল সাদী। বাকি টাকা চাকরিতে যোগদানের সময় পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। রংপুর শহরের একটি রেস্টুরেন্টে তাদের মধ্যে টাকা লেনদেনের একটি ভিডিও ক্লিপ ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
এদিকে সাদীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর চাকরি দিতে টালবাহানা শুরু করেন তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী। একপর্যায়ে চাপ প্রয়োগ করলে বাধ্য হয়ে ভুয়া নিয়োগপত্রের একটি ফটোকপি দিয়ে সাদীকে কাজে যোগদান করতে বলা হয়। সেই নিয়োগপত্র নিয়ে তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে গেলে কর্র্তৃপক্ষ তা ভুয়া বলে জানায়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহকারী প্রক্টর মাসুদ উল হাসানকে আহ্বায়ক করে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাসুদ উল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।’
প্রতারণায় অভিযুক্ত শেরেজামান সম্রাট এর আগে ২০১৯ সালে নীলফামারীর চাঁদখানের বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমানকে সেকশন অফিসার (গ্রেড-১) পদে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি করেন। সে অনুযায়ী চার ধাপে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েও চাকরি পাননি মিজানুর রহমান। ওই লেনদেনের অডিও রেকর্ড এবং খুদেবার্তা দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একপর্যায়ে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে মিজান টাকা ফেরতের জন্য চাপ দেন। তখন ২০১৯ এর এপ্রিলে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি (স্মারক নং-বেরোবি/রেজিঃ/পুনঃ নিঃ বিঃ/ওছঅঈ/২০১৯/২৬৫) দেখিয়ে সম্রাট বলেন, ওই বিজ্ঞপ্তি তাকে নিয়োগের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে।
মিজানুর রহমান জানান, প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারলে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় সম্রাটের অফিসে তিনি বেশ কয়েকবার যান। কিন্তু প্রতিবারই তিনি বিভিন্ন টালবাহানা করেন। ক্রমাগত চাপের মুখে বাধ্য হয়ে দুই দফায় ১ লাখ ফেরত দিয়ে অবশিষ্ট টাকার জন্য ইস্টার্ন ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরের ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি চেক দেন সম্রাট। যদিও সেই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। এ ঘটনায় পরবর্তীকালে মধ্যস্থতা করতে আসেন সম্রাটের সহযোগী সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ। তিনি বিষয়টি মীমাংসার নামে ধারদেনা পরিশোধের একটি অঙ্গীকারনামা তৈরি করেন। যাতে কয়েক দফায় টাকা পরিশোধের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে আর কোনো টাকা দেওয়া হয়নি মিজানুর রহমানকে।
প্রতারণার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে শেরেজামান সম্রাটের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, ‘সম্রাটের বিরুদ্ধে এর আগেও বিভিন্ন অভিযোগের খবর শুনেছি। ইতিমধ্যে প্রশাসন একটা অভিযোগের বিপরীতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অপরাধীকে ছাড় না দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘সম্রাটের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। দুই কমিটির সুপারিশের আলোকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।দেশ রূপান্তর