জুলাই যোদ্ধা আরিফুল
‘কেউ আমাদের কথা ভাবুক’

ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট। আপামর সব শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নেমে আসলে চালানো হয় নির্বিচারে গুলি। এতে শিশুসহ কয়েক শতাধিক মানুষ নিহত হন এবং আহত হন কয়েক হাজার।
ডাটাবেজ অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৮৬৪ জন নিহত ও ১৪ হাজার আহত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে গত ১৩ এপ্রিল জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। আর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আর এই হত্যাকাণ্ডকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেছে সংস্থাটি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন আরিফুল ইসলাম নামের এক যুবক। একে একে চারটি বুলেট এসে তার শরীরে এসে লাগলে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটি পড়েন তিনি। এরপর জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে তিনি দেখেন তার পা দুটি আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিনি যে দু’পা দিয়ে আর হাটতে পারবেন না- এটি ভেবেই বার বার চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে এই জুলাই যোদ্ধার।
আরিফুল ইসলাম রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চিকিৎসাধীন। চারটি বুলেটের মধ্যে এখনও দুটি বুলেট তার শরীরে রয়ে গেছে। আর এই কারণে ক্ষত স্থান দিয়ে এখনও বের হয় রক্ত। শরীরে (পা) রয়ে যাওয়া বুলেট দুটি বের করা হবে কি না- সে বিষয়ে আরিফুল এখনও অজানা। বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আরিফুলের পা ভালো হবে কি না- তা-ও জানেন না তিনি।
এ বিষয়ে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট আমার পায়ে চারটি গুলি লাগে। দুটি গুলি বের করা হয়েছে। আর এখনও দুটি গুলি পায়ের ভেতরে আছে। ফলে ব্যাথায় রাতে ঘুমাতে পারি না। পা অবশ হয়ে আছে। কখনও সুস্থ হবো, না কি হবো না- সেটা জানি না। দেশের অবস্থা এখন এমন হয়ে গেছে যে চিকিৎসার ব্যাপারে কেউ ভাবে না। তারা ভাবে যার যার রাজনীতি আর নির্বাচন নিয়ে। আমার পা থেকে এখনো রক্ত বের হয়। আমাদের কষ্টগুলো বলার কেউ নাই। আমাদের দাবি একটাই, আগে চিকিৎসা হোক। আমাদের চিকিৎসা না হলে, আমরা সুস্থ না হলে আপনারা কীভাবে নির্বাচন চান। আমাদের উপর ভর করেই তো আজ আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের যারা আহত করল, মেরে ফেলল তাদের বিচার চাই আগে।’
আরিফুল আরো বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন- যে দুটি গুলি এখনও ভেতরে আছে, তা বের করা সম্ভব না। এখন তারা কী করবেন, সে বিষয়ে পরিস্কারভাবে কিছু বলছেন না চিকিৎসকরা ।
এ বিষয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ‘অনেকেরই শরীরের ভেতরে গুলি আছে, এটা সত্যি। কিন্তু সেই গুলিগুলো এমন অবস্থায় আছে যে সেটি বের করলে নার্ভের সমস্যা হতে পারে। দেখা গেছে গুলিটি ভেতরে গিয়ে একটা অবস্থান করে নিয়েছে। সেটা এখন বের করতে গেলে ওই ক্ষত স্থানে আরো অনেক বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে চিকিৎসকরা এসে তাদের দেখেছিলেন। তারাও বলেছে যে, গুলিগুলো এখন বের করা সম্ভব না। তবে যে গুলিগুলো বেশি রিস্ক, সেগুলো বের করা হয়েছে।’
মিরপুর ১০ নম্বরে ব্যবসা করতেন আরিফুল ইসলাম। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। তার প্রায় এক বছর বয়সের ছোট একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। কিন্তু তিনি ৯ মাস ধরে অচল অবস্থায় থাকায় অসহায় হয়েছে পরিবার। শুধু আরিফুল নয়, তার মতো বা তার চেয়েও বেশি আরো অনেক আহত পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছেন।
তাদের শুধু একটাই দাবি- হয় তাদের পুনর্বাসন করা হোক এবং পরিবারকে যাতে রক্ষা করতে পারে- তেমন একটা ব্যবস্থা করা হোক সরকারের পক্ষ থেকে। যেহেতু দেশের মানুষের জন্য তারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাই তারা চান- কেউ তাদের নিয়ে একটু ভাবুক।