ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন : তিন ইস্যুতে সংশয়

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে, এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যৌথ বিবৃতিতে। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যেই সংস্কার এবং জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এখন পর্যন্ত মৌলিক কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছে কমিশন। মোটাদাগে তিন বিষয়ে ঝুলে আছে আলোচনা। বিষয়গুলো সমাধান না হলে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয় কাটছে না।
কখনো নেপথ্যে, কখনো আনুষ্ঠানিক সংলাপের যেটুকু প্রকাশ্যে আনা হয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে কী কী জোগাড়যন্ত্র করে, কীভাবে এবং ঠিক কখন জাতীয় নির্বাচন করা যাবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশ দূরত্ব রয়ে গেছে। এ দূরত্ব থাকার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের সপ্তম দিন গতকাল রোববার তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হলেও সত্যি কথা হচ্ছে, আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) মাঠে সক্রিয় দলগুলোর সাম্প্রতিক বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে আইনসভার গঠনপ্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলো কমপক্ষে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগে জাতীয় নির্বাচন চায়; অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি চায় আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তারা মনে করছে, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে দল তিনটির ভালো করার সুযোগ আছে। এতে বিএনপি এককভাবে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ফল পেতে পারে, এমন ধারণা ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে। এর বাইরে নির্বাচন কমিশন ও মাঠ প্রশাসনের অবস্থাও যাচাই হয়ে যেতে পারে।
আইনসভায় দলগুলোকে প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যরা কী প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হবেন, তা নিয়েও আছে মতভেদ। বিএনপি ও সমমনারা চায়, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে নিম্নকক্ষে প্রতিটি আসনে এমপিরা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে; আর উচ্চকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক হারে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন চায়, উভয় কক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন দলগুলোর মোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। আর এনসিপি চায় নিম্নকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে; আর উচ্চকক্ষে মোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচন করার পর আনুপাতিক হারের বিধানের আওতায় আইনসভার নির্বাচন করা গেলে উভয় কক্ষে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সদস্যসংখ্যা সরাসরি ভোটে নির্বাচনে জিতে আসা সদস্যের তুলনায় বেশি হতে পারে, এমন আশাবাদ আছে এই তিন দলে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও আইনসভায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিটি গত শুক্রবার ঢাকায় এক সমাবেশে জোরালোভাবে তুলেছে সংশ্লিষ্ট দলগুলো। ইসলামী আন্দোলনের আয়োজনে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সমমনারা এ দাবি তোলে। এ দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান থাকায় বিএনপি ও তার সমমনাদের সেখানে আমন্ত্রণ করা হয়নি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। এতে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাই করা যাবে। শুক্রবার সিলেটে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আদালতের মাধ্যমে জুলাই হত্যাযজ্ঞের কিছু অভিযোগের নিষ্পত্তি করা এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বাধ্যবাধকতা সংবিধানে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রায় সব দল একমত হয়েছে। চলতি জুনের মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলোয় ঐকমত্যে পৌঁছানো গেলে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী মাসের শুরুর দিকে ‘জুলাই সনদ’ অথবা ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ একটি দেওয়া যেতে পারে, এমন আশা দেখিয়েছিল সরকার। বাস্তবে অনেক বিষয়ে দলগুলোর অনড় অবস্থানের ফলে জুলাই সনদ নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘জুলাই সনদ’ সইয়ের আশা ছিল ঐকমত্য কমিশনের। কিন্তু এটি সেদিনই সম্ভব না-ও হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন দাবি জানানো এবং সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল নিলেও মুহাম্মদ ইউনূস ঠিক কী করতে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে প্রায় সব মহলে। লন্ডন থেকে ফেরার পর তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের আলোচনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ইস্যু হিসেবে সীমিত আকারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার বিষয়টি এসেছে, এমন আভাস দিচ্ছেন উভয়ের ঘনিষ্ঠজনেরা। এ কারণে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
অন্যদিকে, সরকারের ভেতর-বাইরে অনেকে মনে করছেন, আনুষ্ঠানিক সংলাপ ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের বাইরেও বিভিন্ন মহল নানা ইস্যুতে সংলাপের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাচ্ছে। এতে করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টায় গতি আনা যাচ্ছে না।
জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনটি আগে হবে, সংসদে প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নির্ণীত হবে, জুলাই সনদ হবে কি না—এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই আরেকটি বিষয়ও বেশ জোরালোভাবে সামনে এসেছে। তা হলো সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য একটি কমিটি গঠনের বিষয়ও সংবিধানে যুক্ত করতে চায় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের এ প্রস্তাব সমর্থন করছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ কয়েকটি দল। তবে এই ধরনের কমিটি গঠনকে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার শামিল বলে মনে করে বিএনপি। বিএনপির কারণে মৌলিক সংস্কার আটকে আছে বলে অভিযোগ করেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
সংলাপে বিএনপি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি গতকাল বলেন, ঐকমত্য কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা ঠিক করতে হবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেসব বিষয়ে সনদে আনা যেতে পারে। যেগুলোতে হবে না, সেগুলো এখন বাস্তবায়ন হবে না। ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সব প্রস্তাব এখনই মানতে হবে, সে ধারণা থেকে বের হওয়ার তাগিদও দেন তিনি।
সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠনসংক্রান্ত সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়টি গতকালের সংলাপে তুলে ধরেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি পরে সাংবাদিকদের বলেন, সার্চ কমিটি থাকলেও সাংবিধানিক পদে নিয়োগ হতো প্রধানমন্ত্রীর গোপন তালিকা থেকে। সংবিধানে বিষয়টি যুক্ত হলে প্রধানমন্ত্রীর হাত-পা বেঁধে দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা ভুল-বোঝাবুঝি থেকে বলা হচ্ছে, এমনটা তিনি মনে করেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করা এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়া জাতীয় নির্বাচন হবে না, এমন দাবির বিপক্ষে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে, নির্বাচনের অবস্থা সর্বনাশ করে দিয়ে এ জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে।’ গতকাল ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
এনসিপি মনে করে, সরকার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তার কোনো উদ্যোগ নেই। এই অভিযোগ তুলে ধরে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল বলেন, সরকার এ বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ায় এনসিপির উদ্যোগে আগামী ৩ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের গত ১০ মের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।