ঢাকা রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১


ড. কামালের বিলম্বিত উপলব্ধি, তবুও ধন্যবাদ


২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৩২

আপডেট:
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:৩৩

প্রভাষ আমিন

ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যক্তি। বাংলাদেশের যে ক’জন ব্যক্তি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, সম্মানিত; তিনি তাদের একজন। মজাটা হলো, ড. কামাল হোসেন সারাজীবন রাজনীতি করলেও ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান হতে পারেননি। তার নামের আগে কেউ কখনো বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বা প্রবীণ রাজনীতিবিদ লেখেননি।

ড. কামাল হোসেনের নামের আগে আমরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, সংবিধান প্রণেতা ইত্যাদি লিখি। পাঁচদশক রাজনীতি করেও রাজনীতিবিদ হতে না পারাটা তাকে বেদনার্ত করে কিনা জানি না। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখনই আইনজীবী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় পান। বঙ্গবন্ধুর টানেই রাজনীতিতে আসা ড. কামাল ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুততম সময়ে একটা অসাধারন সংবিধান উপহার দেয়ার কৃতিত্বও তার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতেও রয়েছে ড. কামালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

শেখ হাসিনাও নৌকার টিকেটে তাকে রাষ্ট্রপতি পদে, এমপি পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদ হতে না পারা ড. কামাল কখনো জিততে পারেননি। সারাজীবন অনেক সম্মান পেলেও অনেক ভোট পাননি। এই যে এখন তিনি সরকার বিরোধী বৃহত্তর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক, এখনও কিন্তু কেউ ‘কামাল ভাইয়ের সালাম নিন, ধানের শীষে ভোট দিন’ স্লোগান শোনা যায় না। তিনি কখনো সাধারন মানুষ বা কর্মীদের ‘কামাল ভাই’ হতে পারেননি। তবে রাজনীতিবিদ হওয়ার তৃষ্ণাটা তার যায়নি কখনো। নব্বই দশকের শুরুতে আওয়ামী লীগের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর গণফোরাম গঠন করেন তিনি। সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা ড. কামাল কিন্তু প্রায় তিন দশক ধরে তার দলের সর্বেসর্বা। গণফোরামে কি গণতন্ত্র আছে?

জীবনভর রাজনীতি করেও রাজনীতিবিদ হতে না পারাটা তাকে কতটা পোড়ায় জানি না, তবে আমার খুব খারাপ লাগে। আমি বরাবরই চাই ড. কামালের মত সৎ, আদর্শবান মানুষের হাতেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকুক। পাঁচ দশক রাজনীতি করছেন, প্রায় তিন দশক নিজে একটা দল চালাচ্ছেন; কিন্তু কখনো তিনি মাস্তান পোষেননি, চাঁদাবাজি করেননি, তার দলে টেন্ডারবাজ নেই, মনোনয়ন বাণিজ্য নেই। আমরা সবসময় চাই এমন লোকের হাতেই রাজনীতি থাকুক। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা উল্টো। এখানে কামাল হোসেনরা আনফিট।

সাহসের অভাবে বা ঘটনাচক্রে ড. কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিলেন পাকিস্তানে। দেশে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও ড. কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ, মানবিক রাষ্ট্র গড়াই তার সারাজীবনের সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধুর সাথে ফিরেই সেই চেতনায় দেশ গড়ার জন্য কাজ করেছেন। এই শেষ বয়সে এসে তিনি লড়াইটা করছেন, সেটাও গণতন্ত্রের জন্যই। তবে এবারের লড়াইটা তার নিজের নয়। এটা মির্জা ফখরুলের কেইস, ড. কামাল লড়ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে ড. কামাল সেটা স্বীকারও করেছেন, কয়েক মাস আগে মির্জা ফখরুল সাক্ষাত করে দেশের পরিস্থিতি বর্ননা করে সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের দায়িত্ব নিতে বললে তিনি সম্মত হন।

মিলে গেল। আমরা জানি কয়েক মাস আগে মির্জা ফখরুল ড. কামাল হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার কেস নিয়ে। ড. কামাল তাতে রাজি হননি। আমার ধারনা এরপর মির্জা ফখরুল বেগম জিয়ার মুক্তির কেসকে গণতন্ত্র মুক্তির লড়াইয়ের আবরণে সাজিয়ে ড. কামালের সামনে উপস্থাপন করেন। তাতেই পটে যান ড. কামাল।

আসলে ঝানু উকিল ড. কামাল কাবু হয়ে যান চতুর পলিটিশিয়ান মির্জা ফখরুলের কাছে। কার্যত ড. কামাল এখন বেগম জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন, বিএনপির পুনর্বাসন, জামায়াতকে নতুন জীবন দেয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত থেকে বন্দী গণতন্ত্র মুক্ত করে তিনি তা তুলে দিতে চাইছেন যারা একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছে, যারা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে; তাদের হাতে। আমিও গণতন্ত্রের মুক্তি চাই, কিন্তু চাই না সেটা অন্য কোনো খাঁচায় বন্দী হোক।

ফাঁদটা এমন কঠিন, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি ড. কামাল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই ড. কামাল বারবার বলে আসছিলেন, তিনি স্বাধীনতা বিরোধী কারো সাথে ঐক্য করবেন না।

এটা শুধু মুখের কথা নয়। এটাই তার বিশ্বাস। তিনি বিএনপিকে বলেছিলেন জামায়াতকে ছেড়ে আসার জন্য। কিন্তু মির্জা ফখরুল তাকে বোঝাতে পেরেছিলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নেই, তাই তাদের অস্তিত্বও নেই। আর ঐক্যফ্রন্টে আসছে শুধু বিএনপি, ২০ দল নয়। কিন্তু মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সময় সব খোলাসা হয়ে গেল। ঐক্যফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যত ড. কামালের হাত থেকে চলে গেল মির্জা ফখরুলের হাতে।

অদৃশ্যে নিয়ন্ত্রণ আরো দূরে কোথাও। বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দেদার বাণিজ্য চললো। নিবন্ধনহারা জামায়াত ধানের শীষ পেলো ২২ আসনে, আর বিএনপির লাইফলাইন হয়ে আসা ড. কামালের গণফোরাম পেলো ৭ আসন। সেদিনই আসলে ড. কামাল লড়াইয়ে হেরে গেছেন। তিনি এমন বিপাকে পড়েছেন। পরাজয় সইতেও পারেন না, কইতেও পারেন না।
শহীদের তালিকা
তিনি যে হেরে গেছেন, সেটা আমরা দেখেছি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌথে। জামায়াত নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি মেজাজ হারান। সাংবাদিককে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। খামোশ বলে মুখ বন্ধ করে দিতে চান। কিন্তু কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন তিনি? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যে তার সাক্ষাতকার নিয়েছে, তারাও কিন্তু একই প্রশ্ন করেছে।

বাংলাদেশের সাংবাদিককে ‘খামোশ’ বললেও ভারতীয় সাংবাদিককে পারেননি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, ‘যদি জানতাম জামায়াত নেতারা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করবেন, তাহলে আমি এতে যোগ দিতাম না। কিন্তু ভবিষ্যৎ সরকারে যদি জামায়াত নেতাদের কোনও ভূমিকা থাকে, তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একদিনও থাকবো না।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলছে হচ্ছে জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়াটা বোকামি। আমি লিখিত দিয়েছি যে, জামায়াতকে কোনও সমর্থন দেওয়া এবং ধর্ম, মৌলবাদ, চরমপন্থাকে সামনে আনা যাবে না।’ দেরিতে হলেও ড. কামাল বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন, সত্যটা স্বীকার করেছেন বলে তাকে ধন্যবাদ। দেশের মিডিয়াকে খামোশ বললেও যৌক্তিক প্রশ্নের উত্তরটি বিদেশি মিডিয়াকে হলেও দিয়েছেন, তাতে তাকে ধন্যবাদ।

সত্যটা স্বীকার করলেও ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা তিনি করেননি। ড. কামাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সাক্ষাতকার দিয়েছেন ২৬ ডিসেম্বর, প্রকাশিত হয়েছে ২৭ ডিসেম্বর।

ড. কামাল তাকে ভুল বুঝিয়ে ফাঁদে ফেলার জন্য যাকে দায়ী করেছেন, সেই মির্জা ফখরুলকে পাশে বসিয়ে ২৭ ডিসেম্বরেই সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সেখানে অবশ্য জামায়াত প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তিনি, ‘ সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ধানের শীষের পক্ষে ভোট বিপ্লব করার’ আহবান জানিয়েছেন। ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাওয়া মানে কিন্তু জামায়াতের ২২ জনের পক্ষেও ভোট চাওয়া।

ভোট বিপ্লব করে যদি ড. কামাল ক্ষমতায় আসতেন, তাহলে ভালোই হতো। কিন্তু ড. কামাল নির্বাচন করছেন না, কোনো দায়িত্বও নেবেন না। তার মানে ভোট বিপ্লব হলে ক্ষমতায় আসবে জামায়াত-বিএনপি। দেশের দায়িত্ব নেবেন মির্জা ফখরুল, সাঈদী, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানরা। ড. কামাল কি তাতে খুশী হবেন?

প্রভাষ আমিন