ঢাকা শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর..


১৬ জানুয়ারী ২০২০ ২২:৩৯

আপডেট:
১৬ জানুয়ারী ২০২০ ২২:৫৩

মনে হয়, এই সেদিন! জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বেঞ্চে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। পরিচিতিপর্বে নতুন আলাপের জড়তা। অমুক অঞ্চলের ছেলেরা এমন হয়, তমুক অঞ্চলের ছেলেদের এড়িয়ে যাবি- বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে এসব আঞ্চলিক-বর্ণবাদী উপদেশ এই জড়তায় বেশি চেপে ধরছিল। ম্যাম-স্যারেরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে স্বাগত জানিয়ে করে নিলেন বরণ। তারপর থেকে ক্লাসের জন্য নিয়মিত যাতায়াত শুরু হতে থাকলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর.

মাস গড়িয়ে বছর যায়, এক বছর, দু’বছর, তিন বছর...ঢাকার সবচেয়ে ঘিঞ্জি এলাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম কোণের বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ভবনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সেমিনার রুম আর কয়েকটি কক্ষ হয়ে উঠলো মফস্বল থেকে একা নগরে ওঠা আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আমাদের ঠিকানা, আমাদের জীবনপাঠ নেয়ার ঘর, আমাদের হাসি-আনন্দ-আড্ডার আঙিনা। এই ক’টি কক্ষে নিয়মিত যাদের কাছ থেকে পাঠ নিতে থাকি, তারা হয়ে ওঠেন আমাদের অভিভাবক। এই পাঠগ্রহণে যারা সতীর্থ, তারা হয়ে ওঠে ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী, হৃদয়ের মানুষ। আমরা ভুলতে থাকি গাঁয়ে ফেলে আসা মায়ের আঁচল, মাটির গন্ধ, চাঁদনী রাত, খেলার মাঠ ছেড়ে আসার দুঃখ। বুনতে থাকি বিজয়ী হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু সময় এই স্বপ্ন বোনার দিন দীর্ঘ হতে দেয় না। কখন যে আমাদের পাঠ নেয়ার আনুষ্ঠানিক সাঙ্গ হয়, তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সময়ের তাড়া খেয়ে কেউ আগে, কেউ পরে- আমরা ঢুকে পড়ি জীবন-সংগ্রামে। এই সংগ্রাম আমাদের ব্যস্ততার পুলসিরাতে উঠিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেও কারও তেমন বোধ হচ্ছিল না। হল ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম বলেই মনে হয় কেউ দূরত্ব বোধ করছিল না।

তবে এবার সেই আবেগ স্পর্শ করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে, আনুষ্ঠানিক সনদ প্রদান বা বিদায়ের অনুষ্ঠানকে ঘিরে। দু’চারটে মুখের দেখা ঢাকায় নিয়মিত মিললেও চার-পাঁচ বছর আগে অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করার পর অনেকেরই দেখা মিলছিল না। এত বছর পর সমাবর্তনে সেই তাদের দেখে উচ্ছ্বাস যেন ঢেউ খেলে গেলো হৃদয়ে। ‘কই ছিলি তুই পার্থ? কোনো হদিসইতো ছিল না তোর?’, ‌‘মালেক! কতোদিন পর তোর সাথে দেখা’! ‘আরে আরমান! সেই যে গেলি, আর ফোনে পর্যন্ত খোঁজ নেয়া যায় না?’ ‘ওয়াও রিয়াজুল!’ বন্ধুরা কে কোথায় কী করি, সেই আলাপের চেয়ে আড্ডা-গল্পে স্মৃতির ডালপালাই মেলে বেশি! ‘দোস্ত, মনে আছে সেই গান...যমুনার জল দেখতে কালো স্নান করিতে লাগে ভালো...?’ ‘চল কৌতুক বলি!’ ‘আচ্ছা, সুমন-শাহীন-সোহেল আসেনি কেন?’ যেই আরিফ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবার হাসি-আনন্দের মধ্যমণি ছিল, তাকে ঘিরেই জমে ওঠে খুনসুটি-আড্ডা।

পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক ধূপখোলা মাঠে সমাবর্তন শেষে গাউন-হ্যাট পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পাশের আহসান মঞ্জিল ও বুড়িগঙ্গা নদীতে নতুন করে স্মৃতি ফ্রেমবন্দি করার উৎসব জমে ওঠে। এই উৎসবকে মুখর করে তোলে বন্ধুদের আড্ডা-খোশগল্প। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ মিলিত হয় আদি ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত এলাকা ওয়ারীর একটি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে। টুকরো টুকরো উচ্ছ্বাস, খুনসুটি, স্মৃতির আড্ডা আয়োজনকে যেন অনন্য রূপ দেয়। মিঠুন মিয়া ভাই-স্যারসহ আয়োজনের উদ্যোগী সবার মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শীতের রাত গড়ায়, সাঙ্গ হয় মিলনমেলা। আমরা ঘরে ফেরার পথ ধরি। এবার আমাদের আবেগকে বশ করতে পারি না।

সেই ’১৪-’১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে আবার মিলনে এই সমাবর্তন আশার আলো হয়ে জ্বলছিল। আজতো সমাবর্তন শেষ! এবার? স্মৃতি টানে পেছনেও! মনে পড়ে, ক্লাস শুরু হওয়ার আগে গানের আসর-আড্ডা। যাকে-তাকে আরিফের দুষ্টুমিচ্ছলে মারধর। ক্লাসের ফাঁকে বাহাদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জিলে দল বেঁধে ঘোরাঘুরি। মনে পড়ে, পরীক্ষার আগের রাতে আরিফ-টিটুর বাসায় গিয়ে উঠতাম। ওদের সঙ্গে পড়বো বলে। কী পড়াপড়ি! আড্ডা-দুষ্টুমিতে চলে যেতো সময়। ক্লাস ধরতে মামুনের যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে কী দৌড়! সোহরাওয়ার্দী কলেজের পেছনের বাসায় বাজিত-হান্নান-জাফরদের সঙ্গে ওঠার পর প্রায়ই রান্না করে খেতে হতো, বারান্দা রুমে বসে খেলা দেখতে দেখতে খাওয়া! এক বন্ধুর লিটলম্যাগ প্রকাশের পর সেটার প্রচারে অন্য বন্ধুর লেগে থাকা। এলাকা চিনতে বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, ধোলাইখাল, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজারে আনমনে ঘোরা। হৃদয়ের ক্যানভাসে উঁকি দেয় আরও কতোশতো স্মৃতি, মান-অভিমান।

যাদের সঙ্গে এতো স্মৃতি বুনেছি, এতো মান-অভিমানের দিন কাটিয়েছি, সমাবর্তনমেলা শেষে এরা আবার নিজ নিজ ঘরে-কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে। কবে আবার মিলবো? ক’জনতো সমাবর্তনেও এলো না! কবে এভাবে আর পাবো সবাইকে? আদৌ পাবো? নাকি জীবনানন্দের সেই কবিতার সুরই কাঁদিয়ে যাবে বাকি জীবন- ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।

বিশেষ নিবেদন
১. প্রিয় হেলেনা ফেরদৌসী ম্যাম। ঢাকায় যখন আমরা উঠি, অভিভাবকশূন্যতায় অসহায় বোধ হতো। আপনি সেই শূন্যতা কাটিয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছেন সবার অভিভাবক। মায়ের-গাঁয়ের মমতা ছেড়ে ঢাকায় ওঠা শিষ্যদের জন্য আপনার অভিভাবকত্বের আসন দীর্ঘস্থায়ী হোক।

২. বিশ্বাসীরা বলেন, আমাদের ভাগ্যে কী আছে, আমরা জানি না। জানেন মহামহিম। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর ‘সবার কাঙ্ক্ষিত বিদ্যাপীঠে’ ভর্তি হতে না পেরে তখন অনেক আফসোস ছিল। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে সেই আফসোস উবে গেছে। কেবল উবেই যায়নি, এখন কৃতজ্ঞতায় যেন নুইয়ে পড়ি! সেখানে ভর্তি হলে হয়তো এখানকার মতোই একটা চাকরির প্রয়োজনীয় ডিগ্রি পেতাম, কিন্তু তাকে আমি কোথায় পেতাম? যে আমার জীবন সংগ্রামের বড় সাহস, আমার ছোট্ট স্বপ্নকে আকাশসম করার বড় প্রেরণা, আমাকে ‘আমি কে’ বুঝিয়ে দেয়ার সমঝদার, কোথায় পেতাম আমার বন্ধু সরোজ মেহেদীকে? প্রিয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তোমায় টুপিখোলা অভিবাদন, ডিগ্রির বাইরে আমাকে এতো বড় একটা উপহার দেয়ায়! পরের জনমেও মেহেদী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে আমাকে ঠাঁই দিও!

লেখক
হুসাইন আজাদ
সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ (২০০৯-১০)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়