মতামত
অশনি সংকেত: যখন ভেঙে পড়ে সামাজিক সুরক্ষার দেয়াল

একটি রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো তার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যখন নাগরিকরা নিজ গৃহে, রাস্তায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তখন রাষ্ট্রের অন্যান্য সমস্ত উন্নয়ন ও অর্জন ম্লান হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, বর্তমান বাংলাদেশে খুন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং কিশোর গ্যাং তথা মব সন্ত্রাসের লাগামহীন বিস্তার জনমনে তীব্র উদ্বেগ এবং হতাশার জন্ম দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, সরকার এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে অনেকাংশেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
চলমান দুটো ঘটনার উদারণ দেওয়া যায়, ভোলার তজুমদ্দিনে স্বামীর চোখের সামনে স্ত্রীকে গণধর্ষণ। জামালপুরের ইসলামপুরে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নৃশংসভাবে হত্যা। বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা, কিন্তু দুটিই এক অভিন্ন ও ভয়ংকর বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে। এই বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া এবং শক্তিমান হয়ে উঠেছে যে, তাদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবন, সম্মান কিংবা একজন জনপ্রতিনিধির সামাজিক অবস্থান-কোনো কিছুরই আর মূল্য নেই। এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নয়, এটি সামাজিক সুরক্ষার দেয়াল ভেঙে পড়ার এক অশনি সংকেত।
চাঁদা না পেয়ে একজন মানুষকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা-এর মাধ্যমে অপরাধীরা শুধু ভুক্তভোগী পরিবারটিকে নয়, পুরো সমাজকে একটি বার্তা দেয়। বার্তাটি হলো, ‘আমরা যা চাই, তাই করতে পারি। আইন, বিচার, সমাজ বা মানবিকতা-কোনো কিছুই আমাদের থামাতে পারবে না।’
তজুমদ্দিনের ঘটনাটি পাশবিকতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এখানে অপরাধের ধরনটি লক্ষ্য করার মতো। এটি কেবল যৌন লালসার বশবর্তী হয়ে করা কোনো অপরাধ নয়; এটি ক্ষমতার দম্ভ, চাঁদাবাজি এবং চরম অমানবিকতা এক বীভৎস প্রদর্শনী।
চাঁদা না পেয়ে একজন মানুষকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা-এর মাধ্যমে অপরাধীরা শুধু ভুক্তভোগী পরিবারটিকে নয়, পুরো সমাজকে একটি বার্তা দেয়। বার্তাটি হলো, ‘আমরা যা চাই, তাই করতে পারি। আইন, বিচার, সমাজ বা মানবিকতা-কোনো কিছুই আমাদের থামাতে পারবে না।’
ভুক্তভোগী নারীর ‘ভাই’ বলে পায়ে ধরে বাঁচার আকুতিও যখন পাথর গলাতে পারে না, তখন বুঝতে হবে আমরা এক চরম মূল্যবোধহীনতার যুগে প্রবেশ করেছি। ঘটনার পর পুলিশের তদন্ত শুরু হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে না পারাটা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই আরও উস্কে দেয়। উপরন্তু, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভিকটিমের স্বামীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে করা মন্তব্যটি কেবল অপ্রাসঙ্গিকই নয়, বরং মূল ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টার সামিল, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।
অন্যদিকে, জামালপুরে একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাকে রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটি অপরাধীদের ধৃষ্টতার আরেকটি ভিন্ন মাত্রা উন্মোচন করে। যখন অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করার সাহস পায়, তখন সাধারণ মানুষের আস্থার শেষ আশ্রয়টুকুও নড়বড়ে হয়ে যায়। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যিনি দুবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এবং এলাকায় ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে পরিচিত, তাঁকেও যদি নিজের ঘরে এমন নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমেয়।
এই হত্যাকাণ্ডটি ইঙ্গিত দেয় যে, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে সহিংসতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ন্যূনতম সমাধানের পথও আর অবশিষ্ট নেই।
এই দুটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্ঘটনা নয়। বরং সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে বাড়তে থাকা হত্যা, খুন, গণপিটুনি (মব ভায়োলেন্স), চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মতো অপরাধগুলোরই প্রতিচ্ছবি।
প্রতিটি অপরাধের সঙ্গেই কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য জড়িয়ে আছে:
১. অপরাধীর বেপরোয়া মনোভাব: অপরাধীরা এখন আর গোপনে অপরাধ করছে না। তারা দিনে-দুপুরে, প্রকাশ্যে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অপরাধ করছে। তাদের মধ্যে ধরা পড়ার বা শাস্তি পাওয়ার ভয় দৃশ্যত কমে এসেছে।
২. বিচারহীনতার সংস্কৃতি: অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা, রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাবে বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়া এবং চূড়ান্তভাবে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া-এই বিষয়গুলো নতুন অপরাধী তৈরিতে উৎসাহিত করছে। যখন একজন অপরাধী দেখে যে তার পূর্বসূরিরা অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছে, তখন সে আরও বেশি দুঃসাহসী হয়ে ওঠে।
৩. সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়: ভোলার ঘটনায় ধর্ষকদের আচরণ কিংবা গণপিটুনির নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাগুলো সমাজের গভীরে ছড়িয়ে পড়া নৈতিক অবক্ষয়ের প্রমাণ। অর্থ ও ক্ষমতার লোভে মানবিকতার বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে এই অবক্ষয়কে আরও ত্বরান্বিত করছে।
৪. রাজনৈতিক ছত্রছায়া: অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্থানীয় চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী বা দখলবাজদের পেছনে কোনো না কোনো রাজনৈতিক শক্তির আশ্রয় থাকে। এই ছত্রছায়ার কারণে তারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না।
সব মিলিয়ে, ভোলার গণধর্ষণ থেকে শুরু করে জামালপুরের হত্যাকাণ্ড-সবকিছুই একটি অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থার উপসর্গ। যখন চাঁদাবাজির জন্য একজন নারীকে তার স্বামীর সামনে ধর্ষিত হতে হয় এবং একজন জনপ্রতিনিধিকে নিজের বাড়িতে খুন হতে হয়, তখন বুঝতে হবে সমস্যাটি অনেক গভীরে। এটি শুধু পুলিশের ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও বিচারিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আইন প্রয়োগ করাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার। অপরাধী যে দলের বা যে পরিচয়েরই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে পুলিশ ও বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি। এই ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে এখনই যদি রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে এই ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার অন্ধকার একসময় আমাদের সকলকেই গ্রাস করবে। তখন আর কেউই নিরাপদ থাকবে না-না ঘরে, না বাইরে।