ঢাকা রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


– গোলাম রাব্বানী

বঙ্গবন্ধু, বড় ভুল দেশে জন্মালে তুমি!


৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:৫২

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:৫৭

 গোলাম রাব্বানী

স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা। বাংলাদেশ, সূচনালগ্ন থেকে কেটে গেছে ৪৭টি বছর। কী পেলাম এতদিন পরে এসে, ভাবতে বসলেই চোখটায় পানি ধরে রাখা দায়। যে জাতি একটা তর্জনীর গর্জনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মাতৃভূমি রক্ষা করতে সেই জাতি তার সবচেয়ে মূল্যবান সন্তানকে নিজের হাতে মেরে ফেললো। হায় বঙ্গবন্ধু, বড় ভুল দেশে জন্মালে তুমি। যে দেশটার জন্য ১৪ বছর কারাগারে কাটালে, নির্যাতনের স্বীকার হলে, সেই দেশটাই তোমার পরিবারসহ তোমাকে বুলেটে গেথে দিলো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলো তোমার আদরের দুই সন্তান। সেদিন তোমার প্রিয় হাসু বেঁচে না গেলে কেমন করে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি পেতাম, ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে। তোমার আদর্শ বুকে ধারণ করে, তোমার নীতি মেনে চলে দেশটাকে আজ নিয়ে গেছে সুউচ্চ মর্যাদায়। যে মার্কিনিরা আমাদের তলা বিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করতো আজ তারাই তোমার প্রিয় হাসুকে সমীহ করে চলছে। তোমার প্রিয় হাসুই যে আজ আমাদের শেষ আশার আশ্রয়স্থল। তোমার প্রিয় হাসু ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বারের মত ক্ষমতায় এসে দেশটাকে একদম পাল্টে দিলো, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিরলস পরিশ্রম করতে লাগলো। এই যেমন আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পদ্মাসেতু বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক দূর্নীতির ধুয়া তুলে, নানা ষড়যন্ত্র করে থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো আমাদের স্বপ্নটাকে। অথচ তোমার প্রিয় হাসু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিলেন এক সাহসী ভূমিকা, বললেন- কেউ টাকা না দিলেও আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে হবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ। কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না, আড়ালে আবডালে হাসির ফোয়ারা ছুটলো, কটাক্ষ করা হলো আমাদের। কিন্তু আজ আর আমরা স্বপ্ন দেখি না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের অপেক্ষা করি। কারণ আমাদের পাশে আছে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা, যে তোমার মত এই দেশটাকেও নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসে। আর তাইতো আমরা এগিয়ে যাওয়ার পথে কোন বাধাকেই আর বাধা মনে করি না।

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগে কুচক্রী মহল কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক সেই ঋণচুক্তি স্থগিত করে এবং ২০১২ সালের জুন মাসে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। অন্যান্য দাতা সংস্থাও বিশ্বব্যাংকের দেখানো পথই অনুসরণ করে এবং তারাও ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এবং সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ২০১৪ সালের ১৭ জুন মূল সেতুর নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ লি.-এর সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার।

পদ্মা সেতুর অবয়ব এখন দৃশ্যমান। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে ছিল বাধা আর বিপত্তি। সেই বাধাদানকারী সবার মুখে পড়েছে চুনকালি। বাঙালির মাথার ওপর হতাশার কালো মেঘ আর নেই। নেই ঘন কালো অন্ধকারও। স্বপ্ন এখন সত্যি সত্যি বাস্তবে পরিণত। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সংকল্প আর অসীম সাহসিকতায় সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আজ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে চলছে। মূল পদ্মা সেতুসহ পুরো প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৭০ শতাংশ। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুতে বসবে মোট ৪১টি স্প্যান। প্রতিটি স্প্যনের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। র্যা কড স্টিল টিউবুলার ড্রাইভিং পাইল প্রতি পিলারে ছয়টি পাইলের ব্যাস ৩ মিটার। পাইলের দৈর্ঘ্য ১২৮ মিটার। মোট পাইপের সংখ্যা ২৪০টি। স্প্যানের ভেতরে থাকছে রেলপথ ও সড়কপথ। সেতুর ওপরের ডেকের প্রস্থ ২২ মিটার, নিচের ডেকে থাকবে সিঙ্গেল ট্র্যাক ডুয়েল গেজ রেললাইন, ডেকের উচ্চতা ১৩.৬০ মিটার, নেভিগেশনাল ক্লিয়ারেন্স ১৮.৩০ মিটার। এটি শুধু একটি বিশাল অবকাঠামো নয়, এটি শুধু ৬.১৫ কিলোমিটারের একটি স্বপ্নের সেতুই নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ একটি জাতির সামর্থ্য প্রমাণের সঠিক এক অধ্যায়। এই বিশাল অবকাঠামো আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার প্রতীক।

এ সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলা রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে প্রতিদিন সেতুর ওপর দিয়ে ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে। দ্বিতল পদ্মা বহুমুখী সেতুর পুরোটাই হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরের তলায় যাবে চার লেনের মহাসড়ক, নিচে দিয়ে যাবে রেললাইন। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষই সুফল ভোগ করবে না, এ সেতুর দ্বারা বাংলাদেশের সব অঞ্চলের তথা ১৬ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ বাড়বে এবং প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়া-১ এ থাকবে টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, ওজন স্টেশন, আর সার্ভিস এরিয়া-২ এ ডুপ্লেক্স বাড়ি, মসজিদ, হোটেল, মেস, চিত্তবিনোদন ভবন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পানির ট্যাংক, ইলেকট্রিক সাবস্টেশন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ইত্যাদি।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহু ছোট-বড় কল-কারখানা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং জনসাধারণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর মোংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল অবস্থিত। পদ্মা সেতু চালু হলে এসব বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার ফলে যেমন ব্যয় ও সময় কমবে, তেমনি এ সেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও যথেষ্ট সহায়ক হবে। শুধু তা-ই নয়, মাওয়া-জাজিরা অবস্থানে এশিয়ান হাইওয়ে এএইচ-এক এ পদ্মা সেতু অবস্থিত। তাই এ সেতু চালু হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থাসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারেও এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেতুর সুন্দর অবয়ব আর ভারী ভারী ক্রেন এবং যন্ত্রপাতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত বিশাল মাপের কাজ হচ্ছে। বিশ্বে আমাজন নদীর পরই অন্যতম দীর্ঘতম ও খরস্রোতা নদী হচ্ছে পদ্মা। এই নদীর গভীরতা ও স্রোতের প্রখরতা জয় করে সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের সেতু।

– গোলাম রাব্বানী

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ