ঢাকা রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩১


ভালোই হলো ইশতেহার, প্রশ্ন বাস্তবায়ন নিয়ে


২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:৩২

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০৬:২৬

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতিসহ ইশতেহার ঘোষণা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে ইশতেহারের বিভিন্ন দিক নিয়ে চলছে, নানারকম বিশ্লেষণ। তবে সিংহভাগ বিশ্লেষকই ইশতেহারে উল্লেখ করা লক্ষ্যমাত্রা কতটা অর্জন বা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহার কোন দল কেমন দিল, এ বিষয়ে খুব বেশি চোখ নেই সাধারণ ভোটারদের। তারা ইশতেহার থেকে বেশি চিন্তিত নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে। ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন কিনা, তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘোষিত ইশতেহারে দফায় দফায় অনেক স্বপ্নের কথাই বলা হয়েছে। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই চ্যালেঞ্জ পূরণে দলগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে সেটা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন অঙ্গনের বিশ্লেষকরা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচলক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের নরম সুরে নানা কথা শোনার সুযোগ হয়। সেখানে তারা দেশ নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে নানা ভালো ভালো কথা বলেন। কিন্তু শেষঅব্দি তার বেশিরভাগ অংশই অপূর্ণ থেকে যায়। ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির ইশতেহার উচ্চাভিলাষী বলেই মনে হয়েছে। অনেক প্রস্তাব, অঙ্গীকার… সবগুলোই ইতিবাচক; কিন্তু কতখানি ডেলিভার করতে পারবে তা বিবেচনার বিষয়।

তিনি বলেন, সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন করার কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। এটা সুন্দর আইডিয়া। সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এ ধরনের কমিশন করা হয়, সেখান থেকে ধারণা নিয়েছে। কিন্তু তারা যেটা বলছে বলে মনে হয়েছে- বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন-এ ধরনের অপারাধ ১০ বছরে যা ঘটেছে তার জন্যে এ কমিশন। কথা হচ্ছে, গত ১০ বছর কোন, এর আগে থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা গুম, খুন হয়নি? এ প্রশ্নটি মানুষের মনে উঠবে। আসল উদ্দেশ্যটা কী? এটা কি প্রতিশোধ পরায়ণতা? নকি সত্যিকার অর্থে উপস্থাপন করা হবে। যে অপরাধগুলো নিয়ে তারা কথা বলছে তা সমঝোতার বিষয় নয়, বিচারের বিষয়। যারা অপরাধ করেছেন তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা- এ কথা বলার শক্তি দেশবাসী চায়। যারা এগুলোর শিকার হয়েছেন তাদেরকে ন্যায়বিচার দিতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী ভালো কথা বলেছেন। ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন- প্রধানমন্ত্রীর এ কথা খুবই ইতিবাচক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারণত এ রকম কথা শোনা যায় না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভুল স্বীকার করেন এরকম দৃষ্টান্ত কম। প্রধানমন্ত্রী আরও ভালো বলেছেন, ‘ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। দেশবাসী আশা করতে পারে, যেসব ঘাটতি ছিল তা উত্তরণ ঘটাবে আওয়ামী লীগ, যদি এবার ক্ষমতায় যায়।অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলেছে আওয়ামী লীগ। তার মানে সকলের জন্য উন্নয়ন। জাতীয় প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে হচ্ছে, উন্নয়নও রয়েছে; এটা কৌশলগতভাবে ভালো প্রস্তাব। মনে রাখতে হবে, কোনো দেশে উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় না যদি মানুষের বাক স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। তা হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব হয় না। আওয়ামী লীগের আমলে বিশেষ করে গত দুবছরে কতগুলো আইন হয়েছে- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন… যাতে মানুষের মতপ্রকাশ, গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, সেগুলো যদি তারা সংস্কার করে, ঢেলে সাজায়, তাহলেই প্রস্তাবটি অর্থবহ হবে; তা না হলে ফাঁকাবুলি হয়ে থাকবে।দর্নীতি রোধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হয়েছে। জনগণ এর শতভাগ বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করে। এ জন্য দুটি পূর্বশর্ত আছে- প্রথমত: যারা দুর্নীতি করেন তাদের বিচারের আওতায় আনা; দ্বিতীয়ত: যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব, তাদের কার্যকর করতে হবে।

বিএনপির ইশতেহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলটি সব শ্রেণির মানুষের দাবির কথা মাথায় রেখে ইশতেহারে প্রতিশ্রুত দিয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কর্মসূচি তারা দেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিএনপি কোনো কথা বলেনি, জামায়াতকে তো ২২টা সিট দিয়েছে। মানবাধিকার ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থানে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপির ইশতেহারে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব ইতিবাচক। তবে প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবে না- তাদের এ প্রস্তাব স্পষ্ট নয়।দুই মেয়াদে কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না- এটা শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো পার্টিকে ভোট দেয়, প্রধানমন্ত্রীকে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী থাকল কি থাকল না, সেটা তো কোনো বিষয় না। তার ভাই বা তার সন্তানও তো থাকতে পারে। বিএনপি দেওয়ার খাতিরে ইশতেহার দিয়েছে, কিভাবে বাস্তবায়ন করবে- তা স্পষ্ট নয়।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ বহু সুদূরপ্রসারী সংস্কারের অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে অঙ্গীকার করেছে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির অবসানের। অঙ্গীকারগুলো আকর্ষণীয়। কিন্তু এসবের সার্থকতা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর। ইশতেহার বাস্তবায়নে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সফলতা নেই বললেই চলে। যেমন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে বাংলাদেশ টিআইয়ের দুর্নীতি সূচকে প্রথম হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘বিদ্যমান সীমাহীন দুর্নীতির’ মূলোৎপাটন করার অঙ্গীকার করে। কিন্তু তাদের শাসনামলে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

তিনি আরও বলেন, একইভাবে দিনবদলের সনদ শীর্ষক একটি যুগান্তকারী নির্বাচনী ইশতেহার দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেছিল। রাষ্ট্রের সব স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি নির্মূল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণমুক্ত রাখা, মন্ত্রী-সাংসদসহ ক্ষমতাধরদের বাৎসরিক সম্পদের হিসাব প্রদান, সংসদকে কার্যকর করা ইত্যাদি অঙ্গীকার দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরও অন্তর্ভুক্ত ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও বিকেন্দ্রীকরণকে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হলে আমরা আজ অন্য বাংলাদেশ পেতাম।

সুজন সম্পাদক বলেন, এবারের ইশতেহার ঘোষণার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো, অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য জনগণের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান এবং সেসব থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার। আমাদের রাজনীতিবিদেরা সাধারণত ভুলত্রুটি স্বীকার করেন না। এই অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে অন্যদেরও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার আহ্বান জানাই।

বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক ইশতেহার প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নির্বাচন এলে রাজনৈতিক দলগুলো যে মেনোফেস্টো বা ইশতেহার ঘোষণা করে, তাতে জনগণের খানিকটা আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু আস্থা আছে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমরা যদি অতীতের নির্বাচনগুলোর ইশতেহারের দিকে লক্ষ্য করি, দেখব প্রতিটি দল সর্বোচ্চ ভালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যারা ক্ষমতায় আসে, তারা তখন সব ভুলে যায়। ইশতেহার এখন ঘোষণাতেই আটকে থাকছে। ইশতেহার এখন কথার কথা। এছাড়া উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছেও। কিন্তু সেই উন্নয়ন সমাজে আরও বৈষম্য বাড়াচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো দৈন্যদশায় পড়েছে। সমস্যা চিহ্নিত হবে কীভাবে, সমাধান করা যায় কীভাবে তার কোনো ইঙ্গিত নেই ইশতেহারগুলোয়।

তিনি আরও বলেন, একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং সংসদে উচ্চকক্ষের মতো বিষয়গুলো একটি জোটের ইশতেহারে গুরুত্ব পেয়েছে। নতুন এই বিষয়কে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। আর সব বিষয়গুলো পুরনো বলে মনে হয়েছে। বৈষম্য, বেকারত্ব, আর্থিক বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতিরোধে কী করণীয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেয়া হবে কি-না তার ইঙ্গিত নেই।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রসঙ্গে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, যেসব অর্থনৈতিক অঙ্গীকার তারা করেছে, তা একবারে হঠাৎ থলে থেকে বের করা হয়নি। সরকারের চলতি এবং ধারাবাহিক যেসব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলোই তুলে ধরা হয়েছে। নতুন ইশতেহারে দারিদ্র্য হার, অতি দারিদ্র্য হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে, যা দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত যুগোপযোগী পদক্ষেপ। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, মেগা প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। সবই ইতিবাচক। ৫ বছরের মধ্যে অতিদারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা একধরনের চ্যালেঞ্জ , তবে অসম্ভব নয়।