ছাত্রদলের নয়া নেতৃত্বে আলোচিত হচ্ছেন যারা

সদ্য সমাপ্ত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু ও জাকসুর ফল বিপর্যয়ে বিএনপিকে শুনতে হচ্ছে নানা সমালোচনা।
জানা গেছে, কমিটি গঠনের পর থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আমানউল্লাহ আমান নানা কারণে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে পারেননি। ছাত্রদলের এমন কর্মকাণ্ডে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ।
জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ছাত্রদলে তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্ব তুলে আনতে তিনি নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করে সম্ভাব্য সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সুপার ফাইভ কমিটির নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
সূত্র বলছে, চলতি মাসের শেষদিকে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে নতুন কমিটি পেতে পারে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। দলের বিশ্বস্ত সূত্রমতে, ভোটের মাঠে সংকটে পড়া এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতাসহ নানা কারণে সংগঠনটিতে নতুন নেতৃত্ব আনতে চায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাওয়ার সুযোগ পায়। অনেকটা নির্বিঘ্নে সংগঠন গোছানোরও পথ তৈরি হয়। কিন্তু এক বছরের মাথায় এসে সেভাবে সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে না পারা, ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে বিএনপির দায়িত্বশীলদের সমন্বয় এবং সহযোগিতার ঘাটতি, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে ছাত্রদলের তৎপরতা গতি পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে খুব কম সময়ের মধ্যে কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি নতুন নেতৃত্ব গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড।
দলীয় সূত্র বলছে, মূলত ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা এই তিনজন তাদের অদক্ষতায় ছাত্রদলকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সূত্র থেকে জানা যায়, সারা দেশে ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটিতে ২ হাজারের বেশি ছাত্রলীগ ও শিবিরকর্মী রয়েছে। যেটার দায়ভার বর্তমান কমিটি এড়িয়ে যেতে পারে না বলে আঙুল তুলছেন বর্তমান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্যাগী নেতাকর্মীরা।
ছাত্রদলের চলতি কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা বিগত সরকারের আমলে রাজপথের একাধিক ত্যাগী নেতাকর্মী বলছেন, ছাত্রদলের এমন বিপর্যয় মেনে নেওয়ার মতো নয়। এ ছাড়াও ডাকসুর নির্বাচনে সরাসরি দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা জেনেও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা কেন ফলাফলের আগে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করল না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না বিএনপিপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এসব বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সহসভাপতি জানান, ছাত্রদলের দায়িত্বে থাকা ৩ ব্যক্তির কাছে জিম্মি ছিল ছাত্রদল। সারা দেশের ছাত্রদলের ত্যাগীদের অভিযোগ- যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লবিং লাইনে দুর্বল থাকায় কমিটির যোগ্য জায়গায় তাদের রাখা হয়নি। বরং জেলা কমিটি থেকে শুরু করে আধিপত্যের দাপট ও নিজস্ব কোটায় ঢাকার সাত কলেজের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কমিটি গঠন করা হয় বিবাহিত ও অছাত্রদের দিয়ে, যাদের অনেকের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে।
ছাত্রদলের নতুন কমিটির সভাপতির পদে যারা আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন, তারা হলেন ২০০৬-২০০৭ সেশনের বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, ২০০৭-২০০৮ সেশনের শিক্ষার্থী বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আনোয়ার পারভেজ। আনোয়ার ছাত্রদলের বিগত দিনে রাজপথ ও জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা এবং দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা হিসাবে পরিচিত। ২০০৭-২০০৮ সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম ২০০৮-০৯ সেশনের বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল, সহ-সভাপতি ইজাজুল কবির রুয়েল, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মঞ্জুরুল আলম রিয়াদ। এই পদে আরও যাদের নাম শোনা যাচ্ছেন তারা হলেন, বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি এইচএম আবু জাফর, ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী শরীফ প্রধান শুভ, মোস্তাফিজুর রহমান, আমানউল্লাহ আমান ,এনামুল হক এনাম, জি এম ফকরুল হাসান।
এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনার শীর্ষে যাদের নাম উঠে এসেছে, তারা হলেন ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী ও বর্তমান ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম জিসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনও আলোচনায় রয়েছেন। আন্দোলন সংগ্রামে ফারুকের ও রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম।
সাংগঠনিক সম্পাদক পদে যারা আলোচনায় রয়েছেন, তারা হলেন ২০১০-১১ সেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, ১১-১২ সেশনের রাজু আহমেদ, সোহেল রানা, ইব্রাহিম খলিল ও শামীম আক্তার শুভ। এর মধ্যে রাজু এগিয়ে রয়েছেন। সবাই ধারণা করছেন, রাজু হলেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীর স্নেহাস্পদ।
সিনিয়র সহসভাপতি পদে আলোচনায় নাম উঠে এসেছে ২০০৮-০৯ সেশনের মঞ্জুরুল আলম রিয়াদের। কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি কাজী জিয়াউদ্দিন বাসেতের নামও বেশ আলোচিত। এর বাইরে ২০০৯-১০ সেশনের সালেহ মোহাম্মদ আদনানের নামও শোনা যাচ্ছে।
সেই সঙ্গে প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ, ২০১০-১১ সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম তারিক, ২০১০-১১ সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধরণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ ও যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিংকু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মিনহাজ আহমেদ প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব সামসুল আরেফিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মাসুম বিল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক নাসিরউদ্দিন শাওন এই পদে নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় রয়েছেন।
ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রদলের ফল বিপর্যয় নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। তবে সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। সংগঠনের নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল সভাপতি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১ মার্চ রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাসির উদ্দীন নাসিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ১৫ জুন ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করা হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, সংগঠন কে দুর্বল করার জন্য বিএনপির ভিতরে ও বাহিরে এবং বেশ কিছু মিডিয়া একটা প্রচারণা চালাচ্ছেন, সিনিয়র, জুনিয়র দিয়ে কমিটি করার জন্য। কিন্তু ছাত্রদলের এই ভরাডুবি থেকে উত্তরণের জন্য মেধাবী, শিক্ষার্থী বান্ধব, ইন্টেলেকচুয়াল ছাত্র রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।