ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদে ড্যাফোডিল শিক্ষার্থীরা, র্যাব-ডিবি সেজে টাকা দাবি

ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। ভুয়া র্যাব বা ডিবি পরিচয়ে প্রতারক চক্র অভিভাবকদের ফোন করে দাবি করছে— ‘তাঁদের সন্তান মাদক সেবন বা ব্যবসার দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন।’ এরপর মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হচ্ছে। ওই প্রতারণার চক্রে পড়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন অভিভাবক অর্থও খুইয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে এমন বেশ কিছু ফোনকলের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে কয়েকজন অভিভাবক ভুলবশত টাকা হারিয়েছেন। আবার যারা টাকা দেননি, তারাও নিজেদের সন্তানের নামে এমন অভিযোগ ও সন্তানের ভয়েস ব্যবহার করে এমন কলের কারণে মানসিকভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। শঙ্কায় আছে ব্যক্তিগত তথ্য হারানোর বিষয়টি নিয়েও।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সকল তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এমনটা ঘটেছে। তাদের বক্তব্য, ‘সিস্টেম ব্রেকারস লাইভ (https://systembreakers.live) নামক একটি থার্ড পার্টি সাইটে শিক্ষার্থীদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এই সাইটের মাধ্যমেই একটি প্রতারক চক্র শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে ফোন দিচ্ছে এবং নানা উপায়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শেখ মুহাম্মদ আল্লাইয়ার। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর মেইলে একটি সতর্কবার্তাও দেওয়া হচ্ছে যেন এমন কিছু হলে তারা যেন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রচার হচ্ছে; সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। কিছুক্ষণ আগেও (গত রাতে) এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মিটিং হয়েছে।’ ভবিষ্যতে তথ্য পাচার রোধ, পাচার হওয়া তথ্য কীভাবে নিরাপদ করা যায় এবং অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা যায়— সে বিষয়ে কাজ চলছে।
প্রতারকদের হাতে শিক্ষার্থীদের চলে যাওয়া টাকার ক্ষতিপূরণ বিশ্ববিদ্যালয় দেবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর জানান, এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার অফিস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকরা বলতে পারেন।
গত মঙ্গলবার (২৪ জুন) মিরপুরে বসবাসরত ড্যাফোডিলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীর বাবাকে কল করে জানানো হয়, তার ছেলেকে র্যাব ও ডিবির অভিযানে মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে ভুক্তভোগী পিতা প্রথমে অবিশ্বাস করলে পরক্ষণেই ছেলের কণ্ঠ নকল করে কান্নার আওয়াজ শোনানো হয় তাকে। এরপর ওই অভিভাবকের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে বনিবনা হওয়ায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন তিনি। এই বিষয়ে ভুক্তভোগী সেদিন রাতেই রূপনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
প্রায় একই রকমের ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসানের সঙ্গেও। মাহমুদুল জানান, ২৯ জুন অপরিচিত একটি নম্বর থেকে আমার মায়ের ফোনে কল আসে। অপরপ্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে ঢাকার একটি থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) পরিচয় দিয়ে জানান, ‘আপনার ছেলে একটি অপরাধে জড়িত এবং তাকে আটক করা হয়েছে। এখনই চালান করা হবে, একবার চালান হয়ে গেলে ছয় মাসের আগে মুক্তি পাওয়া যাবে না।’
এরপর নানাভাবে ভয় দেখিয়ে, ‘উপর মহলের চাপ’ ইত্যাদি বলে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরবর্তীতে আমার বড় বোন কলটি রিসিভ করলে তিনি অপরাধ সম্পর্কে জানতে চান। কথিত ‘এসআই’ বলেন, বিষয়টি একটি মেয়েকে ঘিরে। বোন যখন মেয়ের নাম জানতে চান, তখন প্রতারক যে নামটি বলে, সেটি হুবহু সেই শিক্ষার্থীর নাম, যাকে আমি গতকাল একটি ওয়েবসাইটে সার্চ করেছিলাম।
মাহমুদুল আরও জানান, সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, তারা আমার ভয়েস ক্লোন করে কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে আমার বোনের সঙ্গে কথা বলে। ফলে বাসায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। টাকা পাঠাতে গিয়ে দোকানদার ব্যাপারটায় সন্দেহ করে এবং আমাকে ফোন দেয়, তখনই পুরো প্রতারণার বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
মাহমুদুল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে ফাঁস হওয়া খুবই গর্হিত ও বিপজ্জনক ঘটনা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত দ্রুত তথ্য ফাঁসের উৎস শনাক্ত ও রোধ করা, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই ঘটনাটি শুধু একজন শিক্ষার্থীর নয়, বরং পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
ভুক্তভোগী অন্য এক শিক্ষার্থী জানান, ‘প্রথমে যেদিন এমন ঘটনা হয়েছিল, তা ভেবেছিলাম আমাদের সঙ্গেই হওয়া ঘটনা। পরে দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ফাঁসের কারণে এমনটা হয়েছে হয়তো। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এই টাকাগুলো অনেক। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করবো যেন আমার ঘটনা বিবেচনা করে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেয়। না হয় আমার পরিবারের জন্য এই ঘটনা বোঝা হয়ে যাবে।’
প্রতারকের কলের মিথ্যা তথ্যের কারণে স্ট্রোক করে মা মারা যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাতুল ফেসবুকে লিখেছেন, আমার মা’কে হারিয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট তথ্য সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের কেউ এই বিষয়টার সঙ্গে জড়িত—হয়তো তারা বাসার মোবাইল নাম্বার, পরিচয় দিয়ে সহায়তা করছে। এটা তাদের এখন নতুন ফন্দি। এই প্রতারক চক্রই আমার বাসায় ফোন দিয়ে আম্মাকে বলে, ‘আপনার ছেলে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, ইমার্জেন্সি ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ডাক্তার সেজে ১০ হাজার টাকা চায়।’ আমার অসুস্থ ভয়েস কপি করে মাকে শোনায়। আমার মা তা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িতে ব্রেন স্ট্রোক করে—হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান। এই প্রতারকের কারণে আমি মা’কে হারিয়েছি। বের করতে পারলে একজনকেও ছাড়ব না আমি!
জানা গেছে, বেশকিছু দিন আগে ওই শিক্ষার্থীর বাড়িতে ফোন করে প্রতারক চক্র। এদিকে, এসব ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সর্তক করে রেজিস্ট্রার অফিস থেকে শিক্ষার্থীদের একটি ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’ ইমেইল করা হয়েছে।
প্রতারণামূলক ফোন কল সম্পর্কে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’তে বলা হয়েছে, ‘‘আপনাদের সকলকে প্রতারণামূলক ফোন কল সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন থাকার জন্য আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।’’
নিচের বিষয়গুলো মনে রাখবেন
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কখনোই ফোন করে কোনো ধরনের ফি বা পেমেন্ট জানতে চাওয়া হবে না; সকল অফিসিয়াল যোগাযোগ শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য চ্যানেলের মাধ্যমে হয়—যেমন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ইমেইল বা স্টুডেন্ট পোর্টাল; কোনো ব্যক্তি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি পরিচয়ে ফোনে ব্যক্তিগত বা আর্থিক তথ্য জানতে চায়, তবে তার পরিচয় যাচাই না করে কোনো তথ্য শেয়ার করবেন না।
আপনার কাছে যদি এ ধরণের কোনো ফোন কল আসে, তাহলে করণীয়
রেজিস্ট্রার অফিসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সঙ্গে সঙ্গে ফোন কলটি কেটে দিন এবং কোনো কথোপকথনে জড়াবেন না। একইসঙ্গে কোনো তথ্য শেয়ার করবেন না; ঘটনাটি অবিলম্বে স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স অফিস বা প্রক্টর অফিসে রিপোর্ট করুন। আপনার নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র এবং এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে আইগত ব্যবস্থা নিয়েছি এবং শিক্ষার্থীদের সচেতন করছি।’