বাংলাদেশে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা কবে কমবে?

প্রতিদিন টিভি বা খবরের পাতা খুললেই দেখা যায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবর।
এটি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসকল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারাচ্ছে উঠতি বয়সের তরুণেরা। অনেক অভিভাবকই আবদার পূরণে তাদের কম বয়সী সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন উচ্চগতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল। কিন্তু এই শখের মোটরসাইকেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মৃত্যুর ফাঁদ। আবার অনেকে পরিবারের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। অথচ এই তরুণদের অধিকাংশই কোনো নিয়ম মানে না। এমনকি লাইসেন্স ছাড়াই মহাসড়কে বাইক চালানোর সাহস করে তারা। এতে তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যান্য পথযাত্রীদের জীবনও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
গবেষকদের মতে, অন্যান্য যানের চেয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঝুঁকি ২৯ গুণ বেশি। সারাদেশে দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরে কেবল মার্চ মাসেই ৫৮৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ দশমিক ২২ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে এবং এতে প্রাণহানি ঘটেছে ২৩৩ জনের। শুধু মার্চ মাসেই নয়; ফেব্রুয়ারিতে ৫৯৬ টি সড়ক দুর্ঘটনার ২৪১ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, যাতে নিহতের সংখ্যা ২২৭ জন । জানুয়ারিতে মোট নিহতের ৪৩.৩ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর মতে, ২০২৪ সালে প্রায় ৬ হাজার ৯২৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৭৬১ টি মোটরসাইকেল দ্বারা সৃষ্টি হয়। এতে নিহত হয় ২ হাজার ৬০৯ জন, যা মোট নিহতের প্রায় ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বরাবরই বেশি।
বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। বিশেষ করে রাতে মহাসড়ক ফাঁকা পেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা স্পিড অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়িয়ে উন্মাদের গাড়ি চালায়, যা দুর্ঘটনা ঘটার সর্বোচ্চ আশঙ্কা সৃষ্টি করে।
দেশে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানের সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। গত ৩০ মার্চ, ঈদের আগের দিন পাথরকাটা মঠবাড়িয়া এলাকায় সোনারবাংলা নামক স্থানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একইসাথে আপন ৩ ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে। এতে বিষাদময় হয়ে যায় পুরো পরিবারের ঈদ। শুধু ঈদের আগে পরে ১৫ দিনে কেবল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫১ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ চালকই সঠিকভাবে মোটরসাইকেল না চালানো শিখেই রাস্তায় নেমে পড়েন। অনেকে বড় ভাই কিংবা চাচার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং সাথে রয়েছে হেলমেট ব্যবহার না করার তীব্র প্রবণতা। গ্রামাঞ্চলে হেলমেট এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। তাই কেউ যদি সঠিকভাবে বাইক না চালাতে পারে, তাহলে তাকে না চালাতে দেওয়াই উত্তম।
শহরে হেলমেট ব্যবহার করলেও তা খুবই নিম্নমানের, যা দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে পারে না।
এছাড়া রাস্তায় মোটরসাইকেল এর জন্য আলাদা কোনো লেন নেই, ফলে বারবার লেন পরিবর্তনের ফলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে রাস্তায় মোটরসাইকেল চলাচলের আলাদা লেন তৈরির মাধ্যমে দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও রোধ করা যেতে পারে।
ওভারটেকিং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ। রাস্তায় এক গাড়ির সাথে অন্য গাড়ির নোংরা প্রতিযোগিতা বিরাট দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। ওভারটেকিং এর সময় ছোট্ট একটি ভুলের জন্য বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে। তাই তাড়াহুড়ো না করে, বুঝেশুনে ওভারটেকিং করতে হবে।
মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে সামনের যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরি। বেশিরভাগ চালকরাই এ-বিষয়ে খেয়াল রাখে না। সামনের গাড়ি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রাখলে, হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক করলেই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এ-বিষয়টি সকল মোটরসাইকেল চালকদের মাথায় রাখতে হবে।
গ্রামাঞ্চলে অনেক কৃষকের সন্তানও মোটরসাইকেল এর মতো এতো দামি জিনিস কেনার জেদ করে। অনেক সময় চাপের মুখে পড়ে সন্তানের জেদ পূরণে বাধ্য হয় তারা। অথচ তেল যোগানের টাকা পর্যন্ত নেই তাদের। তাই সন্তানকে সঠিক পারিবারিক শিক্ষা দেওয়া খুবই জরুরি।এছাড়া নেশাদ্রব্য পান করে বাইক চালানো, চলন্ত অবস্থায় ফোনে কথা বলা দুর্ঘটনা সৃষ্টির কারণ।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সর্বপ্রথম চালকদের সচেতন হতে হবে। বাইক চালানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত স্পিড বাড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সঠিকভাবে চালানো শিখেই
রাস্তায় নামতে হবে।
লাইসেন্স বা হেলমেটবিহীন চালকের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতার মাধ্যমে সবকিছু সম্ভব। অনেকসময় পুলিশ লাইসেন্সবিহীন চালকদের ধরলেও ক্ষমতা দেখিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। তাই এদিকে প্রশাসনের বিশেষ নজর দিতে হবে। নেশাদ্রব্য পান করে গাড়ি চালালে বড় অঙ্কের জরিমানা করতে হবে। সর্বোপরি, সকলের মধ্যে এবিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
সামিয়া রহমান
শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়