দূর্নীতির মহাসমুদ্রে বিআরটিসি !

কর্মকর্তাদের অনিয়মের কারনে দুর্নীতির চরম শিখরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনে (বিআরটিসি)। বিআরটিসি একটি রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা। অথচ এর পুরোটাই দখলে নিয়েছে ব্যপক অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িত থাকা একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও বহিরাগত সিন্ডিকেট, এমন অভিযোগ উঠেছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের অভ্যন্তরীণ যে চিত্র উঠে এসেছে। তাতে সংস্থাটির ভয়াবহ দুর্নীতিই ফুটে উঠেছে। গোয়েন্দা সংস্থাটি এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে যে, দুর্নীতি বন্ধ করা না গেলে বিআরটিসি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। বিআরটিসির দুর্নীতির খবর শুধু গোয়েন্দা সংস্থার কাছেই নেই, খোদ সড়ক ও সেতু পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরেরও নখদর্পণে রয়েছে সংস্থাটির চিত্র।
রাজধানীসহ সারা দেশে বিআরটিসির এক হাজারেরও বেশি বাস ও ট্রাক সচল থাকে।অভিযোগ উঠে এসব পরিবহন থেকে প্রতিদিন যে আয় হচ্ছে, সেগুলো থেকে কয়েক লাখ টাকা পকেটস্থ করছেন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিন্ডিকেট সদস্যরা। বিশৃঙ্খলা আর অনিয়মে জর্জরিত এমন বেহাল গণপরিবহন পৃথিবীর কোনো দেশে দেখা যায় কিনা সন্দেহ থেকে যায়। বিআরটিসির ২১টি ডিপো এখন দুর্নীতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে আর দুর্নীতির মূল হোতা হচ্ছেন ডিপোর ম্যানেজাররা। মাঠ পর্যায়ে চোখ বুলালে এসব অভিযোগের হারে হারে প্রমান পাওয়া যায় ।
এদিকে পি পি আর ২০০৮-এর আইন ও পলিসি অনুসারে, সরাসরি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ২৫,০০০ থেকে ১০,০০০০০ টাকা বছরে ব্যয় করা যায় (পি পি আর পৃ ১৭০৩৪৯-৫১)। কিন্তু কে মানছে পি পি আর’ এর এসব নিয়ম?
সরোজমিনে দেখা যায়, ‘পি পি আর’ নিয়ম অমান্য করে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই টয়লেট নির্মান, অত্যাধুনিক অফিস রুম নির্মান, বালি ভরাট ও অন্যান্য সংস্কার কাজসহ প্রায় ১৯ লাখ টাকার কাজ করিয়েছেন তেজগাঁও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান। কল্যাণপুর ডিপোর ম্যানেজার মোঃ মশিউজ্জামান দুইটি দোকান নির্মাণ ও রুম আধুনিকায়ন করছেন। মতিঝিল ডিপোতে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই রাস্তা, মসজিদ নির্মান, সিবিএ অফিস সংস্কার করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী ডিপোতে দেয়াল নির্মানসহ লক্ষ লক্ষ টাকার কাজ চলছে।
এছাড়া বাসের যন্ত্রাংশ ক্রয় ও বাস মেরামত করাতে কোন প্রকারের টেন্ডার ছাড়াই অধিক মূল্যে বসিয়ে বিল-ভাওসার করানো হয় বলে অভিযোগ আসে। যা স্পষ্টই পি পি আর লঙ্ঘন। এভাবে ‘পি পি আর’ অমান্য করে টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই ব্যপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার কাজ করিয়ে যাচ্ছেন বিআরটিসির বিভিন্ন ডিপো ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ম্যানেজাররা।
টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই কল্যাণপুর ডিপোতে দুইটি দোকান নির্মাণের কাজ চলমান ।
এবিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া বলেন, “পি পি আর-এর বাইরে আমরা কিছুই করিনি। অতি জরুরি কোন কাজ থাকলে আমরা একজন ইন্জিনিয়ারকে সাথে রেখে একটি ক্রয় কমিটি গঠন করি এবং তখন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ফেলি। সেক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য ওয়েট করা যায়না। কারন টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু কল্যাণপুর ডিপোতে যে দোকান নির্মাণের ঘটনা, তা এত জরুরি বিষয় না।”
পি পি আর-এর নিয়ম লঙ্ঘন করে কেন দুইটি দোকান নির্মাণের কাজ করেছেন তা জানতে চেয়ে কল্যাণপুর ডিপোর ম্যানেজার মোঃ মশিউজ্জামানকে একধিকবার ফোন করলে তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি।
এবিষয়ে বিআরটিসির তেজগাঁও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান মহোদয়ের কথার বাইরে আমরা কিছুই করিনা। এবিষয়ে তিনিই ভাল জানেন, আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা বলে উত্তর না দিয়ে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
দিকে কিছু দিনের মধ্যে আরও ১১০০ বাস, ট্রাক বিআরটিসির বহরে যুক্ত হবে, তা কতদিন চলবে সেই প্রশ্ন খোদ বিআরটিসি ডিপোর ড্রাইভার, হেলফারদের ।
বিআরটিসির অসাধু কর্মকর্তাদের চুরি,ঘুষ কিংবা দুর্নীতি বন্ধ করে বিআরটিসিকে বাচাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সড়ক ও সেতু পরিবহনমন্ত্রীর কাছে সাধারন মানুষ বিভিন্ন পোষ্টার, ব্যানারের মাধ্যমে আবেদন জানান।
বিআরটিসিকে দুর্নীতির হাত থেকে বাচাতে আবেদন ।
বিআরটিসির দুর্নীতি রোধ করতে বিশেষজ্ঞদের মতামত : প্রথমেই সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে সংস্থাটির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভেঙে ফেলতে হবে সিন্ডিকেট চক্র। দ্বিতীয়ত, সংস্থার বিভিন্ন স্থাপনা জরুরি ভিত্তিতে টেন্ডারের মাধ্যমে বাজারমূল্যে ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, আয় ও ব্যয়ের হিসাবের শুভঙ্করের ফাঁকি রোধ করে প্রকৃত আয় যাতে সংস্থার অনুকূলে থাকে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। বিআরটিসির শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত বলে জানা গেছে।
বকেয়া পরিশোধ করে কর্মক্ষেত্রে তাদের জীবন্ত করে তুলতে হবে। লুটেরারা লুট করবে আর যারা সংস্থার বাহনগুলোর চাকা সচল রাখছে, তারা মানবেতর জীবনযাপন করবে, তা হতে পারে না।
সম্প্রতি বিআরটিসি কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সড়ক ও সেতু পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সতর্ক করে বলেন, “বিআরটিসিতে যারা বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্বে আছেন, কার কত ইনকাম আমি ভালো করে জানি। কীভাবে ইনকাম হয় তাও জানি।”
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশও দিয়েছেন মন্ত্রী ।একই সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি যেন আর না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। কিন্তু বিভিন্ন ডিপো ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ম্যানেজাররা পরিবহনমন্ত্রীর এসব আদেশ অমান্য করে অনিয়ম আর দুর্নীতিকে সঙ্গী করে লক্ষ-লক্ষ টাকা নিজেদের পকেটস্থ করছেন।