ঢাকা সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


ঢাবিতে এত আত্মহত্যা কেন? কেবল মৃত্যুই মুক্তির পথ নয়


২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:০৬

আপডেট:
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ১০:৫১

শান্তা তাওহিদা

||শান্তা তাওহিদা, অতিথি লেখক||

‘জীবনের লক্ষ্য কী?
আশেপাশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা।
জীবনের সংজ্ঞা কী?
অনেক অনেক বড় হওয়া।
জীবনের পরিনতি কী?
হতাশ হয়ে বেঁচে থাকা।
জীবনের মুক্তি কোথায়?
মরে যাওয়া।
বিদ্রঃ চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থীর আত্নহত্যা করেছে। আর গত ৫ দিনে ৩জন।’…

সহপাঠীর আত্মহত্যার বেদনায় অভিমান ভরা এই ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নোমান সুমন। ১৬ নভেম্বরে তার দেয়া স্ট্যাটাসটি রোজকার হাজারো খবরের ভিড়ে টাইমলাইন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই, আজ ঢাবির আরেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর। ৫ দিনে তিন জনের পর ৭ দিনের মাথায় হারিয়ে গেছে আরও একজন। এভাবেই রোজকার সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মারা যাচ্ছে স্বপ্নেরা। একটি সংখ্যার সাথে আরেকটি সংখ্যা যোগ হয়ে দিনে দিনে বাড়াচ্ছে আমাদের দেনা। কীভাবে আমরা শোধ করব এই জীবন ঋণ?

আমাকে ভাবিয়েছে নোমান সুমনের অভিমান ভরা স্ট্যাটাসটি। জীবনের লক্ষ্য কি আসলেই আশেপাশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা? জীবনের সংজ্ঞা কি শুধুই অনেক অনেক বড় হওয়া? কিংবা হতাশ হয়ে বেঁচে থাকাই কি জীবনের পরিনতি?

আজ প্রত্যুষে মৃত্যুর মিছিলকে ভারী করল যে মেয়েটি মরে গিয়ে কি তার জীবনের মুক্তি হয়েছে?

আমার ইচ্ছে হয় তাকে জিজ্ঞেস করি- হুজাইফা রশিদ তুমি কি মুক্তি পেয়েছ? তুমি কি আজ থেকে গতকালের চেয়ে ভাল থাকবে?

আমাদের সে উত্তর জানার কোন উপায় নেই। তবে প্রিয়জনের কান্না, হৃদয়ের আকুতি বলে দিচ্ছে, প্রিয়জনেরা ভাল নেই। তাহলে তরুণ, রশিদ, ইভা, দানি, মেহের নিগারেরা কী করে ভাল থাকবে?

জীবনের কাছে কী সেই লক্ষ্য, কী সেই প্রত্যাশা যা পূরণ হয়নি বলে জীবনের মায়া কাটিয়ে আকাশের তারা হয়ে যাওয়া যায় আমি জানি না। রোজকারের পৃথিবীর বয়স বাড়ছে একদিন একদিন করে। ধনে-জ্ঞানে-বিজ্ঞানে প্রতিদিন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলছি আমরা । তাহলে রোজ আমাদের কীসের অভাব বাড়ছে? হাজারো মাধ্যমের সামাজিক মানুষগুলো ভেতর থেকে কী ভীষণ একা!

তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা কেন বাড়ছে? কী এর পেছনের কারণ?

২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনার দিকে নজর দেয়া যাক-

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
ভালবাসা দিবসের দিন প্রিয়জনের ভালবাসা ছেড়ে স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ হোসেন। আত্মহত্যার ১৫ দিন আগে বাড়িতে গিয়েছিলেন তরুণ। তখন বাবার কাছে বার বার পরীক্ষায় অকৃতকার্যের কথা জানিয়েছেন তিনি। বিভাগে বার বার ফেল করে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। সেসময় তিনি বাবার কাছে জানান, বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই। তার বাবা বলেন, মানসিক কষ্ট, আর্থিক সংকট আর ডিপার্টমেন্টের চাপ সব একসঙ্গে না নিতে পেরে তরুণ চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনান্স এর মত ভাল বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও কেন তরুণ হতাশ হয়ে পড়েন জীবনের প্রতি?

১৫ আগস্ট ২০১৮
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের মুশফিক বাবু নিজ বাসার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে সরকার ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে মুশফিক ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সহপাঠীরা জানান, মুশফিক অনেক হাসিখুশী ছেলে ছিলেন। তার কোন আর্থিক সমস্যা ছিল না। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার মধ্যে ক্ষোভ ছিল। সহপাঠীদের সাথে বিভিন্ন সময়ের আড্ডায় এই কথাগুলো বলতেন মুশফিক।

তাহলে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোন বিষয়টি একজন শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করতে পারে?

১৫ অক্টোবর ২০১৮
পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির হোসেন নিজ ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে আগের দিন রাতে বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয় জাকির হোসেনের। পরে বাবা মায়ের ওপর অভিমান করে সোমবার ভোরে সবার অজান্তে নিজ ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। জাকির হোসেন মৃত্যুর আগে তার ডায়েরির পাতায় ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ এমন সুইসাইড নোট লিখে গেছেন।

দেশের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী যিনি এক বছরের মধ্যে পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী করে নিজের আর্থিক অনটন নিজেই দূর করতে পারতেন তিনি কেন অভাব-অনটনের কাছে হার মানলেন?

১২ নভেম্বর ২০১৮
রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোস্টেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ফাহমিদা রেজা সিলভির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তেজগাঁও থানা পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস জানায়, অপমৃত্যুর শিকার শিক্ষার্থীর ফাহমিদা রেজা সিলভি শামসুন্নাহার হলের অনাবাসিক শিক্ষার্থী। সোমবার বিকালে ফার্মগেট এলাকার হোস্টেলের একটি কক্ষ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতের সহপাঠী এবং বন্ধুরা জানান, গত কয়েকদিন যাবত সিলভি হতাশ ছিলেন। মনমরা থাকতেন। পরবর্তীতে জানা যায় যে, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই হতাশায় ভুগছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থীকে কেন ফার্মগেটের একটি হোস্টেলে থাকতে হয়েছে? ২য় বর্ষে পড়েও তিনি ক্যাম্পাসে মেয়েদের হলে একটি আসন পাননি? তিনি দীর্ঘদিন ধরেই হতাশায় ভুগছেন, কিন্তু কেন কোন মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি? পরিবারের কেউ কি এই বিষয়গুলো জানতেন না?

১৪ নভেম্বর, ২০১৮
রাজধানীর আজিমপুরে গলায় ফাঁস দিয়ে ঢাবির হোম ইকোনমিকস কলেজের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লায়লা আঞ্জুমান ইভা আত্মহত্যা করেন। মুমূর্ষু অবস্থায় ইভাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক রাত ১২টার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। লালবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খন্দকার হেলাল উদ্দিন জানান, আজিমপুরের শেখ শাহ বাজার এলাকায় একটি বাসার নিচতলায় ইভা আরেক ছাত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। রাতে বাসার জানালার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস দেন ইভা। পরে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর রুমমেট। পরিদর্শক আরো বলেন, ‘আত্মহত্যার কারণ প্রেমঘটিত হতে পারে বলে ধারণা।

মানবিক সম্পর্কের উত্থান পতন থাকতেই পারে। সে কারণে কেন আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্তে আসতে হবে? আমাদের সামাজিকতার ভেতর কি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব? পড়ালেখার জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকে যে মেয়ে বা ছেলেটি তার পরিবার কি নিয়মিত তার খোঁজ-খবর রাখছেন? তার আস্থার জায়গা হতে পারছেন?

১৬ নভেম্বর, ২০১৮
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের সাবেক ছাত্রী মেহের নিগার দানি আত্মহত্যা করেন। ওইদিন দুপুরে এই ঘটনা ঘটে। তিনি ঢাবি থেকে ৫০তম কনভোকেশন নেন। একই তারিখ রাতে ঢাবির আরেক ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হন।

নভেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহে শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গর্বের আয়োজনে শরিক হয়েছেন যে মেয়ে বা ছেলেটি তিনি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখার চিন্তা ছেড়ে কেন আত্মহত্যা করলেন?

২২ নভেম্বর ২০১৮
সর্বশেষ পাওয়া খবর মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী হুজাইফা রশিদ আত্মহত্যা করেন। হুজাইফা রশিদের ফুফাত ভাই বলেন, হুজাইফা টঙ্গিতে তার নিজ বাড়ির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আত্মহত্যা করেন। কী কারণে আত্মহত্যা করল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হুজাইফা তার অ্যাকাডেমিক লাইফ নিয়ে কিছুটা হতাশ ছিল। আমরা তাকে বুঝিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে আত্মহত্যা করে বসল।’

শিক্ষাজীবনের এমন কী হতাশা যেটি বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা, হলের মনোবিজ্ঞানী, টিএসসির কাউন্সেলিং বিভাগে গিয়ে আলাপ করা যায়নি? এর মানে একথা বলছি না যে, ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতখানি সুযোগ থাকা প্রয়োজন তা যথেষ্ট । কিন্তু যতখানি আছে ততখানি সুবিধা কি আমরা নিচ্ছি?

আমার এ লেখা যখন আপনি পড়ছেন তখন এই মৃত্যুর মিছিল আর প্রশ্নের পাহাড় আরো বড় হবে কিনা আমরা জানিনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে এতগুলো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা আমাদের সকলকে নাড়া দিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই কোন একটা জায়গা ঠিকঠাক নেই। কিন্তু কী সেই জায়গা? কী সেই একক কারণ? কী সেই অনেকগুলো কারণ? এই প্রবণতা কি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেই? অতীতে এরকম আত্মহত্যা প্রবণতা ছিল কি?

তথ্য প্রযুক্তির যুগে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বেশি সময় ব্যয় করতে হল না। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম আর পরিসংখ্যানগুলো রীতিমত ভয় ধরিয়ে দিল।

২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে দিলাম এখানে,

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৪ ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন হলের ছাত্র হুমায়ুন কবির হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ২০ অক্টোবর রোকেয়া হলের ছাত্রী উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিল্পী রানী সরকার প্রেমঘটিত কারণে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র আক্তার হোসেন চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একই বছরের ২৮ জুলাই রোকেয়া হলের ছাত্রী সাজিদা আক্তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন। ২০০৭ সালের ২৫ জুন গলায় রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী জোহরা খাতুন প্রজ্ঞা। ওই বছরেই চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেরা খাতুন পাপড়ি নামে এক শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে মারা যান। আবার ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিার্থী ও ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান ইকবাল সজীব চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০১৪ সালে একই ভাবে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাহবুব শাহিন। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুকে ব্যক্তিজীবন নিয়ে হতাশার কথা উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দেন। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় ঢাবিছাত্র ও উদীয়মান সংগীতশিল্পী নাঈম ইবনে পিয়াস রেজা আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর ভাষানটেকে নিজ ঘরে প্রেমিকার ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। তারপর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থী তারেক আজিজ চাকরি না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করেন। সবশেষ নতুন বছরের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অপু সরকার নামে এক ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।…’

এ চিত্র কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়, আত্মহত্যার দিক থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অহরহ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। একই চিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর থেকে মুক্ত নন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। বিগত বছরগুলোর আত্মহত্যার হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

এবারে আসি তরুণদের মধ্যেকার আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার এই চিত্র কি কেবল বাংলাদেশের? আর্থসামাজিক ভাবে কম শক্তিশীল দেশেই কি কেবল এই প্রবণতা দেখা যায়? উত্তর হল, না। একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় ১৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত শিরোনাম ছিল, ব্রিটেনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় বেশি বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। সবশেষ ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ি ব্রিটেনে ১৪৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যার হার কমলেও ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ৫৬ শতাংশ বেড়ে যায় । জরিপে দেখা যায়, পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বেশি হলেও ইদানিং নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের পর্যন্ত জননীতি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষণে এমন চিত্রই উঠে আসে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে তাদের এই সমস্যা বাড়ছে।’

কেবল যুক্তরাজ্য নয়, এশিয়ার চিত্রও একই। বিশেষত জাপানে কয়েক দশকের তুলনায় সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। দেশটির এক সরকারি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, ‘২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে শিশু ও তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা গেছে। প্রসঙ্গত, জাপানে আত্মহত্যার সংখ্যা গণনায় বছর বিবেচনা করা হয় সেপ্টম্বরের ১ তারিখ থেকে। এ হিসাবে ২০০৩ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে মোট আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা কমলেও বেড়েছে শিশু ও তরুণ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৩ সালে জাপানে মোট ৩৪ হাজার ৪২৭ জন আত্মহত্যা করেন। আর ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটি ২১ হাজার ৩২১-এ নেমে এসেছে।’

সারা বিশ্ব জুড়ে দিন দিন কেন বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা? আত্মহত্যার কারণকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার নানাবিধ চাপ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, চাকুরীর সংকট, আর্থিক অনটন, মাদকসেবন, প্রেমে ব্যর্থতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিবারিক কলহ ঠিক এইভাবে মোটা দাগে বললেই আমাদের দায় শেষ হবে না। বরং এখন প্রয়োজন একেবারে মাঠ পর্যায়ের মৌলিক গবেষণা । সময় বদলে গেছে। তার সাথে পালটে গেছে আমাদের জীবন ধারা। নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের জন্য যেমন জানার সুযোগ কাজের সুযোগ বাড়াচ্ছে তেমনি তৈরি করছে নতুন নতুন সমস্যারও। আজকের আত্মহত্যার কারণের সাথে অতীতের কারণ কিংবা ভবিষ্যতের কারণ নাও মিলতে পারে। তাই আমাদের আরও ভাবতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। ইন্টারনেট আসক্তি, সমাজের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাকুরীজীবী বাবা মায়ের সন্তানের জন্য সময় কম দেয়া, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ফেসবুকের বিমূর্ত বন্ধুর মাঝে বুদ হয়ে থেকে সামনের বন্ধুকে ভুলে যাওয়া, ভিডিও গেমের জগতে গিয়ে বিকেলে মাঠের ফুটবলের চল হারিয়ে যাওয়ার মত কারণগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।

আমাদের ভাবতে হবে শারীরিক অসুখের মত মনেরও অসুখ হতে পারে। মনের অসুখ হওয়া মানে পাগল হওয়া নয়। আমাদের যেমন জ্বর-ঠান্ডা হয় তেমনি মনে হতাশাও আসতে পারে, রাগ হতে পারে, জীবন কখনো অসহ্য মনে হতেই পারে। আমাদের শরীরের হরমোনের কম বেশি হলে আমাদের বিষণ্ণ লাগতেই পারে। এই বিষণ্ণ লাগা, হতাশ লাগা এগুলো কোন বড় ঘটনা নয়। শরীরের রোগের মত মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন প্রয়াশ আরও বাড়াতে হবে।

সব থেকে বেশি যা দরকার তা হল, আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাকে মজবুত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের অপ্রাপ্তি কেবল ক্ষণিকের। ক্ষণিকের অপ্রাপ্তির জন্য জীবন এখানেই শেষ তা ভাবা যাবে না। বরং জীবনে সফল তারাই যারা যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। মারা যাওয়া মানেই জীবনের মুক্তি নয়।

শান্তা তাওহিদা
সহকারি অধ্যাপক যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা.নেট থেকে নেওয়া